মানুষকে নিষ্পাপ সুন্দর হবার জন্য কী ধর্মের অনুশাসনের সত্যই প্রয়োজন, এ কাজ তো মানবাত্মার নিজের ধর্ম। মানুষ অশ্রু, বেদনা ও ক্রন্দনের মুক্তধ্বনি–মানুষ প্রেম দ্বারা কি পাপ সম্ভব? ওগো সুন্দরের দেবতা মানুষ! তোমায় নমস্কার। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই প্রকৃতির শান্ত দয়াল মূর্তিতে দেখি প্রভুর গগনজোড়া উচ্ছল অশ্রুর আর্তনাদ। শোকে, গানে, ক্রন্দনে, সুরে বেজে ওঠে প্রভুর অনুনয় মানুষের কাছে–ওরে আমার প্রিয়তম মানুষ! তোরা সবুজ নির্মল প্রকৃতির মতো নির্মল সবুজ সৌন্দর্যে বেড়ে ওঠ। তোরা সুন্দরই-নির্মলই। যে পৃথিবীতে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরছে সেখানে মানুষ কেমন করে মানুষকে দুঃখ দেয়, পাপ করে? স্বর্গের সন্তান তোরা ওরে মানুষ, কেমন করে তোদের হৃদয় পাপ-কালিতে কলঙ্কিত হয়? সমস্ত সবুজ গগনে দেখতে পাই প্রভুর মঙ্গল-বাহু। মানুষকে হাত তুলে তিনি নিষেধ করছেন–ওরে আমার অনন্ত সন্তান, তোরা শোকার্ত উন্মাদিনী সন্তানহারা মেঘ-কুন্তলা চির অমতি প্রকৃতির বুকে দাঁড়িয়ে হিংসার হাত তুলিস নে। তোদের কণ্ঠস্বর নামা। তোদের কথায় মধু ঝরুক। তোরা আপন মনের সহজ ধর্মের অপমান করিস নে। বাঁশি কাঁদে, সুরে কাঁদে, মানুষকে কেবল বলে–ওগো মানুষ, তোরা সুরের মতো সুন্দর হ নির্মল হ। এমন সুন্দর সুরের জগতে মানুষ তোরা পাপ করিস নে সুন্দর হ। এমন সুন্দর সবুজ প্রকৃতির অ–উৎসাহের মাঝে মানুষ কেমন করে পাপ করতে সাহস পায়, বুঝি না। মানুষ তোমরা সুন্দর হও।
তোমরা কাঁদতে শেখ–ভালো করে অশ্রু ফেলতে শেখ। না কাঁদলে কি মনের পাপ ধৌত হয়, মন নির্মল হয়? অশ্রুর গঙ্গায় প্রতি নিশীথে যেয়ে তোমরা আপন আপন জীবনের পাপ ধুয়ে ফেল। এস মানুষ! আমরা প্রেমের সংসার গড়ে তুলি, ফুল আর পাতা দিয়ে দেহ সজ্জিত করি! পাপ আর অত্যাচারের পোশাক পরার চাইতে ঐ পোশাকেই তো মানায় ভালো।
মুসলিমের জীবন শুধু ‘রোজা-নামাজ’ নয়। এরূপ মনে করা মুসলমান ভ্রাতার কোনোমতে উচিত নয়। তার ধর্মের নামেই তো প্রকাশ পাচ্ছে–সে শান্তির সন্তান। হিংসা, মানুষকে দুঃখ দেওয়া তার ধর্ম নয়। পরম শান্তির উপাসক সে। তার ঘরে-বাইরে শুধু প্রেম ও শান্তি বিরাজ করে। হায়! মুসলিম জীবনে এত অশান্তি, এত জ্বালা–এত দুঃখ–এতো অভিশপ্ত শয়তানের জীবন। যে জীবনে প্রভু কর্তৃত্ব করেন, সেখানে কি অশান্তি জ্বালা থাকতে পারে? শীঘ্রই তোমাদের হৃদয়, বাহু, চক্ষু, কর্ণ অবসন্ন হয়ে আসবে। নেপোলিয়ন, সিজার, হানিবল, আলেকজাণ্ডার, চেঙ্গিস খাঁ, সুলতান মাহমুদ, নাদির হালাকু সবারই হয়েছে। সে কথা কি ভাব না?
.
০৯. উপাসনা
একটা পূর্ণাঙ্গ, সুন্দর দুয়ে প্রেমময় মহাশক্তি সৃষ্টির প্রতি স্তরে কাজ করছে। ঐ শক্তি থেকে মানবচিত্ত প্রেরণা ও শক্তি লাভ করে। ঐ শক্তি মানুষ্য জ্ঞানের উৎস।
উপাসনা এই উন্নত মহাশক্তির কাছে চিত্তের প্রণতি, ভক্তি ও বশ্যতা।
উপাসনাহীন জীবন অপবিত্র। যে জীবন দিবা-রাত্রি কোনো সময় প্রভুর অনন্ত প্রেমের কথা স্মরণ করে না–সে জীবন এক অফুরন্ত সম্পদ থেকে বঞ্চিত থাকে। কিন্তু যেভাবে মুসলমান জাতি বর্তমানে উপাসনার অভিনয় করে থাকেন–তা নিরর্থক। আত্মার সঙ্গে যে উপাসনার যোগ নেই তাকে কোনো মতে উপাসনা বলা চলে না। প্রভুর সম্মুখে আত্মার পরম নিরর্ভরতা পরম অনুতাপের অবস্থা; হৃদয়ের বিগলিত অবস্থার নাম উপাসনা। আবৃত্তি কখনও উপাসনা নয়।
প্রভুর পথে অন্যান্য জাতির তুলনায় মুসলমান জাতি হিসেবে প্রত্যহ পঞ্চাশ মাইল পিছিয়ে পড়ছে। তার আধ্যাত্মিক অগ্রগতি নাই। এ ক্ষতি কোনোকালে পূরণ হবে না। কেউ কি প্রাণকে ফেলে দেহের পূজা করে। প্রাণহীন দেহের মূল্য কী? অথচ মোহবশত অনেকে দেহের পূজা করে। তোমাদেরও মোহ জন্মেছে। বোঝ না। ভাষার অর্থের প্রতি লক্ষ্য কর। না, শুধু আরবি ভাষাকে সম্মান কর। অক্ষর কি ভক্তির যোগ্য? এমন যে পূজিত রাজার শরীর, যা জীবনে কত যত্নে, কত সুখে পালিত হচ্ছে, প্রাণহীন হলে তাও দুর্গন্ধ এবং ঘৃণিত হয়ে উঠে–সে শরীর কেউ ঘরে রাখে না। যখন অর্থবোধ হয় না–তখন আরবি ভাষার কোনো মূল্য নেই। তোমরা শুধু মোহবশত ভাষাকে ভালবাসো–এ তো পৌত্তলিকতা। তোমরা তো পৌত্তলিক। অন্তরে যদি ভাব না থাকে, অনুভূতি না থাকে, তবে আল্লাহ্ তোমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করতে পারেন না–কারণ অন্তরে তোমার কোনো ভাব বা অনুভূতি নেই। ভাষা তো মানুষের তৈরি–ভাব মানবচিত্তে প্রথমে জাগে, মানুষ নিজেদের প্রস্তুত ভাষায় তাই প্রকাশ করে। যে চিত্তে ভাব নেই, অনুভূতি নেই, তার ওষ্ঠের ভাষা আল্লাহ্ বোঝেন না। আল্লাহর কাছে তা পৌঁছে না। কী তুমি চাও, তা নিজেই জান না–আল্লাহ্ তোমায় কী দেবেন?
না বুঝে প্রার্থনার ভঙ্গি করা, কোরান পড়া মহাপাপ। এই মহাপাপে মুসলমান জাতির সর্বনাশ হয়েছে, তার সমস্ত উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে গেছে। মুসলমান নরনারী ধর্মহীন, আল্লাহ্হীন, শক্তিহীন জীবনের সর্বকল্যাণ আশীর্বাদ হতে সে বঞ্চিত। তার জীবন ভয়াবহ অন্ধকারে ভরা, ঘোর অশান্তিতে পূর্ণ আগুনে সে পুড়ে মরে।
আল্লাহই মানুষের শক্তি ও প্রেরণার উৎস। মুসলিম জীবনে শক্তি ও প্রেরণা নেই তার জীবনে কোনো পরম ভরসা ও নির্ভরতা নেই। একটি মৌখিক বিশ্বাস সে করে মাত্র। জাতি হিসেবে তার যে সর্বনাশকর ক্ষতি হচ্ছে, তার মীমাংসা কোনো কালে হবে না।