সামান্য সামান্য মাসিক দানে দেশের সর্বত্র হাজার হাজার পীড়িতের আবাস, জলাশয় এবং বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অবহেলিত সামান্য পয়সা এক জায়গায় সঞ্চিত হলে দেশের কত দরিদ্র মানুষের মঙ্গল হতে পারে। কেন অকৃতজ্ঞ নিন্দুক মানুষের উদর-সেবার জন্য অর্থ ব্যয় কর? বরং পীড়িত ও তৃষিতের মুখে শান্তির অমৃত তুলে ধর। এইভাবে দেশের মানুষের পরম আত্মীয় হও এবং জীবন ধন্য কর। আমাদের দেশে মহাপাপে, রোগে, দুঃখে, অনাহারে শত শত নরনারী মারা যাচ্ছে, তাদের কাতর চীৎকার তোমাদের পাষাণ হৃদয়কে গলাবে না কি? পাপ ও অন্ধকারের অতল হতে তাদের উদ্ধার করবে না? মানুষের আত্মীয় হবার এমন সুবর্ণ সুযোগ আর পাবে না। সামান্য হলেও সেবা ও প্রেমের পথে দান কর। এইভাবে বাঙালি জাতির আত্মীয় হয়ে তোমরা আল্লাহর আশীর্বাদ লাভ কর। একজনের পক্ষে বিপুল অর্থ ব্যয় করা এবং সেবার পথে তা দান করা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। প্রভুর পথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দান করা কোনোমতে কষ্টকর নয়। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় অনুষ্ঠানে, সেবা-প্রতিষ্ঠানে, রোগীর আশ্রমে কিছু কিছু দান করা উচিত। এতে কোনোমতে কৃপণতা করা উচিত নয়। যে এই দানে আপত্তি তোলে এবং যে এই সামান্য দানকে আপন জীবনের সুখ-সুবিধার অন্তরায় মনে করে, সে মানুষের আত্মীয় নয়। তার জীবনধারণ বৃথা। পরিবারে দুর্বল নিঃসহায় অধীনস্থদের প্রতি অত্যাচার, মৃত ভ্রাতার বিধবা পত্নী ও পুত্র-কন্যাদের ওপর অত্যাচার, বরিশাল জেলার বিকৃতমস্তিষ্ক ভ্রাতার স্ত্রী মনোরমার মতো নারীর ওপর অত্যাচার কখন ও আত্মীয়ের কাজ নয়।
পরিবারের বুড়া-বুড়িকে জীবনের শেষ অবস্থায় কোনোরকম অসম্মান করা ঘোর নিষ্ঠুরতা। যারা এরূপ করে তারা কখনও প্রিয়জন নয়। Wagram-এর যুদ্ধে ঊর. Sals dirf-এর একখানা পা গোলার আঘাতে একেবারে চূর্ণ হয়ে যায়। তার সম্মুখে একটা আহত সৈনিক গুলীবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল; ডাক্তার নিজে মৃত্যুর পথে দাঁড়িয়েও পরম আত্মীয়ের ন্যায় এই আহত সৈনিক-দেহে অস্ত্রোপচার করে তাকে বাঁচালেন। নিজের বেদনাকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। যিনি নিজকে ভুলে দুঃখীকে এমন করে জীবন দান করেন তিনি আপনার চেয়েও আপনার। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহৎ কাজের সমষ্টিতেই এক একটা মহাজীবন রচিত হয়।
জনৈক কলেজের যুবক তার চাচা-শ্বশুরের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে জনৈক ডেপুটির সঙ্গে দেখা করে বল্লেন; মহাত্মন! আমি দরিদ্র, আমার এক পয়সাও ব্যয় করবার ক্ষমতা নেই। আমার বাড়ি-ঘর-দরজা কিছুই নেই। মৃত শ্বশুরের আত্মীয় নিরন্তর আমাকে নির্যাতন করেন। তাঁর আপন ভ্রাতুস্পুত্রীকে খুন করতে আসেন। আমরা উত্তরাধিকারি হলেও শ্বশুরের পরিত্যক্ত সম্পত্তির কানাকড়ি আমাদেরকে দিতে চান না। মহানুভব ডেপুটি যুবকের আবেদন গ্রাহ্য করলেন। বিনা খরচে তিনি যুবককে সর্ব বিপদ হতে রক্ষা করলেন। যুবকের বালিকা-পত্নী যখন কোটে উপস্থিত হন তখন ডেপুটি এইভাবে কথা বলেছিলেন; মা, তুমি ভয় করো না। সাহস করে আমার সম্মুখে কথা বল। আজ আমি ছাড়া তোমার আর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই–আমি তোমার মা-বাপ। সত্য কথা নির্ভীকভাবে বল, আমি তোমাদের নিরাপদময় ব্যবস্থা করে দেব।
আজকাল বিচারপতির মুখে বিচারপ্রার্থীর প্রতি এমন আত্মীয়ের মতো পরম ভরসার কথা, এমন নিরহংকার প্রেমের সম্বোধন প্রায়ই শোনা যায় না।
জনৈক ডেপুটিকে দেখেছিলাম, তার স্বভাব হাকিমী-চলন মোটেই ছিল না। তিনি সকলের বাড়িতেই যেতেন, সকলের সঙ্গে মিশতেন। বিবাহ উৎসবে যোগ দিতেন। স্বভাবে তাঁর অহঙ্কার ছিল না। একখানা কাপড় পরে সাধারণ মানুষের মতো রাস্তায় বেড়াতেন। বিচারের সময় বিচারকের আসনে গিয়ে বসতেন। অন্যথায় একেবারে সহজ-নিরহংকার ভাব গ্রহণ করতেন। বিচারপতিতে এই আত্মীয়তার ভাব বড়ই প্রশংসনীয়।
.
০৭. সত্য প্রচার
কতকগুলো উড়ে বেহারা আমাদের বাড়িতে থাকে। তাদের মাঝে যারা ধার্মিক তারা প্রভাতে এবং সন্ধ্যায় সূর্যকে মাটিতে মাথা রেখে প্রণাম করে। মানব-জীবনের এই অপমান আমি দেখেছি এবং দুঃখ পেয়েছি।
দরিদ্রদেরকে বড়বাবুর সম্মুখে ভীত বন্দির মতো হাত জোড় করে মাথা নত করে দাঁড়াতে দেখে মনে গোপনে অশ্রু ফেলেছি।
বুড়ো মানুষকে একটা পৈতাধারী অকালকুষ্মণ্ড ব্রাহ্মণ বালকের পদধূলি মাথায় নিতে দেখে মনে বেদনার ঝড় বয়েছে। মানব-জীবনের এই নিদারুণ অপমানের সম্মুখে মুসলমান
জাতি কি দায়ী নয়? তার ধর্ম কি শুধু রোজা-নামাজ?
যদি কোথাও গান-পাউডার থাকে তবে তাতে আগুন ধরিয়ে দাও, জীবন ওর সার্থক হোক! গন্ধে ভরা মানুষের চিত্তকুসুম ফুটিয়ে তোলো–এই হচ্ছে ভক্তের সাধনা। মানব জীবন সার্থক হোক। অন্ধকারে তাকে বিনষ্ট হতে দিও না। ওর মতো ক্ষতি আর নেই। মানুষকে এইভাবে প্রেম কর। বাইরে মানব সমাজে, পথেঘাটে, রাস্তায় ঈশ্বরের বন্দনা গীত গাও। শুধু মসজিদ ঘরে নয়। নিজের মুক্তির চিন্তায় নয়।
সর্বদা ঈশ্বরের গৌরব প্রচার কর। টিকিধারী, মুসলিম ভ্রাতাকে দেখে আমি ভয় পাই–যারা বলদের পিঠে চড়ে এক লম্ফে বেহেস্তের দরজায় উপস্থিত হতে চায়। যারা কোরবানি করে স্বর্গে যেতে চায়। যারা উচ্চকণ্ঠে কথা বলে এবং হঠাৎ মানুষকে কাফের বলে গালি দেয়।