- বইয়ের নামঃ মহা জীবন
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ জয় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০১-০৫. মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
০১. মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
শুভ্র সুন্দর গৌরবের কিরণমালায় যেখানে পৃথিবী হাসিয়া ওঠে সেখানেই মানুষ জাগে–অগৌরবের অন্ধকারে মানুষ নেই।
বজ্র-বিদ্যুৎ যেখানে পৃথিবী শঙ্কিত হয়ে ওঠে সেখানেই মানুষ জাগে-মৌন প্রকৃতির শান্ত মৃত্যুতে মানুষ নাই।
অশ্রু, ক্রন্দন, বেদনার ভিতর দিয়ে মানুষের জাগরণ। সে চঞ্চল বিদ্যুৎ সাগরের তরঙ্গলীলা, যুগ যুগের ক্রন্দন সে, সে স্থির-মৌন নয়। মানুষ মৃত্যুর নীরবতা নয়। শান্ত নয়–সে উল্কা, উচ্ছ্বসিত আবেগ। মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ কোথায়? কেঁদে যখন সে বসে পড়ল, লজ্জায় অনুতাপে যখন সে অশ্রু ফেলল, ক্রোধ বহ্নিতে যখন সে ক্ষিপ্ত সিংহের রোষে যাত্রা করল, যখন সে প্রিয়তমের জন্য কাঁদল, সন্তান শোকে যখন হাহাকার করে উঠল, যখন সে দুর্জয় জলপ্রপাতের মতো দিগ্বিজয়ে বের হল; শান্তির নীরবতার মধ্যে মানুষকে খুঁজে বের করা কঠিন। মেঘভরা আকাশের উৎসবে মানব-চিত্ত নৃত্য করে উঠেছে, বাতাসের সকরুণ সঙ্গীতে চিত্তে তার ব্যথা বেজেছে। মানবাত্মার অগৌরব দেখে সে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করেছে। মানুষের ব্যথায় যে ঘর ছেড়ে বের হয়েছে, জীবনের সর্বসুখ বর্জন করে যে ধুলোর আসন গ্রহণ করেছে, যে অপরিসীম দুঃখ ভোগ করেছে, লাঞ্ছনা সয়েছে, গর্বিতের পদাঘাত সয়ে যে আশীর্বাদ করেছে, ব্যথিতের মর্মবেদনায় তার আঁখিতে ধারা বয়েছে–ওহঃ মানুষ কত বড়!
সহজ নির্বিকার জীবনে মানুষকে পাওয়া যায় না। স্বার্থ সংগ্রামে যখন সে পশুর হীনতায় পথে পথে ঘুরেছে, মানুষকে ব্যথা দিয়েছে, আত্মার চরম অগৌরব করেছে; তখন আমি ঘৃণায় তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছি।
তোমায় মৃত অনুভূতিহীন উপাসনায় রত দেখে আমি সুখী হই নি। পাপ অগৌরবের লজ্জায় যখন তুমি অনুতাপের অশ্রু ফেলেছ তখন আমি তোমায় সম্মান করেছি–এখানেই তুমি জাগ্রত সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠ।
তোমায় তীর্থযাত্রীর বেশে দেখে আমার নয়নে ভক্তিপূর্ণ অশ্রু দেখা দেয় নি। হৃৎপিণ্ডের রক্ত দিয়ে যখন তুমি ধরণী রাঙিয়েছ, তখন আমার হৃদয় গলে পানি হয়েছে, সভয়ে শ্রদ্ধায় করজোড়ে আমি তোমার শোণিত-বিন্দু পূজা করেছি। বাঁশি কেঁদে উঠে তোমার হৃদয়ের মহাগান আমায় শুনিয়েছে; তোমার স্বরূপ আমায় জানিয়েছে। বজ্র ধ্বনিতে তোমার মহিমা আমি অনুভব করেছি তোমার প্রেম-বিহ্বল, বেদনা-কাতর মূর্তিকে জীবিত দেবতা জ্ঞানে আমি পূজা করেছি। সহজ মৃতের জীবনে তোমায় পাই নি।
সহজ জীবনে তোমার প্রকাশ হয় নি। তুমি ঘৃণিত ছোট হীন ও নীচাশয়; ক্ষণে ক্ষণে যে উল্কার আলোক বিদ্যুতের চির-চঞ্চল রুদ্র মধুর সৌন্দর্য, প্রেমের ক্রন্দন তোমার মধ্যে দেখা দিয়েছে–সেখানেই তুমি জেগেছ।
মানব-ভাগ্যে এক সান্ত্বনার জগৎ আছে। মানুষের অপরিণাম দুঃখ, তার শত বেদনার অভিযোগ একদিন সান্ত্বনা লাভ করবে। এই যে বিশ্বজোড়া কলহ-বিবাদ, রক্তারক্তি, কাটাকাটি, হানাহানি–এর শেষ এক চির-অশান্তি ও জ্বালাভরা ভবিষ্যতে, কোনো উন্নত মহাজীবনে ওর আনন্দময় পরিসমাপ্তি হবে না; যেখানে এক অনির্বচনীয় মহাশান্তি মানবাত্মাকে পরম সুখ দান করবে, মানুষের কত আশা, কত বেদনা অমীমাংসিত রয়ে গেল। কত নির্যাতিত আত্মার বেদনা-ঘন অশ্রু বায়ুমণ্ডলকে সন্তপ্ত করে দিয়ে চিরবিদায় গ্রহণ করেছে–তার কি কোনো সান্ত্বনা নেই? জাতের গর্বকে মর্যাদা দিতে, মানুষের ঔদ্ধত্যকে শান্তি দিতে কত অবহেলিত বীর অগ্নিসমুদ্রে রক্তের বুকে প্রাণ দিয়েছে–কোথায় তারা? কোন অনন্ত মহাশূন্য সাগরে মিশে গেছে তারা? তাদের বুকে কি কোনোদিন কোনো সান্ত্বনার হাত পড়বে না? আর যারা জগতে এই দুঃখ সৃষ্টি করেছে তাদের কি কোনো বিচার হবে না? হবে হবে, নিশ্চয়ই হবে।
পীড়িত, ব্যথা-কাতর মানুষ দিবারাত্র হায় হায় করে একদিন শেষযাত্রা করে। সংসার সুখ বঞ্চিত কত দুঃখী একদিন মৃত্যুর কবলে চিরআশ্রয় পেলেন। তাদের জীবনে কি কোনোই পুরস্কার নেই?
এই পৃথিবীতে মানুষের ভাগ্যে যেমন অনন্ত দুঃখ, তেমনি অনন্ত ঐশ্বর্য সম্পদও জুটে থাকে। শত ঐশ্বর্যের পার্শ্বে, নিঃস্ব দুর্বল এবং জগতের কাঙ্গাল ভিক্ষুক হয়ে কত নরনারী পৃথিবীর সর্বত্র পথে পথে কেঁদে মরছে। শক্তিহীন দুর্বল তারা, অযোগ্য তারা, শুধু জগতে হায় হায় করতেই এসেছিল। এতটুকু বাঁচবার অধিকার যেন তাদের নেই। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করে জগতের ফেলে-দেওয়া অনের আকাঙ্ক্ষা করা, জীর্ণ মলিন বস্ত্রকে মূল্যবান রেশমি বস্ত্র ভাবা, কুকুরের ন্যায় ধনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাই এদের জীবনের গৌরব বাসনা। হায়! মানব জীবনের এই দুর্গতি ও অপমান! জীবনের উন্নতি ও উচ্চতম চিন্তা এদের হৃদয়ে প্রবেশ করে না কোনো আশার আলোক এদের জীবনকে ক্ষণিকের জন্য উৎসাহিত ও প্রফুল্লিত করে না। বেঁচে থাকাই এদের জীবনে মস্ত বড় সমস্যার বিষয়। বেশি দিনের কথা নয়–মানব-সমাজ কিছুকাল আগে এদেরকে গরু-ঘোড়ার মতো বিক্রি করতো। মানব জীবনের কোনো মর্যাদা মানুষের কাছে ছিল না। আজ যে স্বাধীন, সৌভাগ্যের সন্তান–কাল হয়তো সে কোনো যুদ্ধে বন্দি হয়ে ধনীগৃহের ক্রীতদাসরূপে বিক্রিত হতো। আজ যে নারী ভাগ্যবতী–বহু গুণী এবং ধনী সন্তানের মাতা, যিনি পরম সুখে সংসারে বাস করেছেন–কালই হয়তো গুরুতর ভাগ্য বিপর্যয়ে তিনি মানুষের ক্রীতদাসী এবং সর্বসুখ, জীবনের সব আনন্দ থেকে বঞ্চিত, ভাবহীন, চিন্তাহীন, বেদনা অনুভূতিহীন কাঠের মানুষ তাকে হতে হতো। যে সম্পদশালী যে চিরসুখী সে কি দুঃখীর বেদনা বুঝতে পারে? যে অনাহারে থাকে নি, সে কি ক্ষুধিত গরীবের দুঃখ অনুভব করতে পারে? যারা সুখী, অভাব মুক্ত, তাদের কাছে এই পৃথিবী এক হাসি-তামাসার বিষয়–তাই দুঃখীর ভগবান-আল্লাহ্ বল্লেন, তোমরা আমার নামে রোজা থাক–যে রমজান মাসে উপবাস করে সে আমার প্রিয় দাস। কারণ দুঃখীর দুঃখ বোঝবার জন্য, মুহূর্তে মুহূর্তে আল্লাহর সর্বগুণ যুক্ত অস্তিত্ব বুকে অনুভব করবার জন্য সে দিবসে অন্ন পানি কিছুই গ্রহণ করে না। সারাদিন উপবাস করেও যদি মানুষ দরিদ্রের বেদনা না বোঝে, তবে সে আর কী উপবাস করে! ধিক তাকে!