হিটলার তখনও আশা ছাড়েননি। কখনও সামনে ম্যাপ খুলে কম্পিত হস্তে রুশসৈন্য, ভেংকের সৈন্য, নবম বাহিনীর সৈন্য রঙিন বোতাম দিয়ে প্রতীক করে যুদ্ধের বৃহ নির্মাণ করছেন, আক্রমণের পথ স্থির করছেন; কখনও চিৎকার করে মিলিটারি হুকুম দিচ্ছেন– যেন তিনি নিজে রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করছেন। কখনও ঘর্মাক্ত হস্তে ম্যাপ নিয়ে দ্রুতপদে পায়চারি করছেন– ভেজা হাতের স্পর্শে ম্যাপখানা দ্রুত পচে যাচ্ছে আর যাকে পান তাকেই সেই ম্যাপ দেখান; কীভাবে, কোন পথে, সমরনীতির কোন কূটচালে শত্রুপক্ষকে নির্মম ঘায়েল করে, যেন এক অলৌকিক বিস্ময়ে ভেংক এসে সবাইকে এই সংকট থেকে মুক্ত স্বাধীন করবেন।
এদের অনেকেই ততদিনে জেনে গিয়েছেন, ভেংকের সেনাবাহিনী বলে আর কিছু নেই। যে ক-জন তখনও বেঁচে ছিল তাদের তিনি অনুমতি দিয়েছেন, পশ্চিম দিকে পালিয়ে গিয়ে মার্কিনদের হাতে আত্মসমর্পণ করতে রুশদের চেয়ে মার্কিনরাই ভালো, এই তখন আপামর জনসাধারণের বিশ্বাস। কিন্তু তেংকের সত্য বিবরণ হিটলারকে বলে কে বলে লাভ? কাইটেল, ইয়োডল সব জেনে-শুনে হিটলারের অতিনাদী টেলিগ্রামের পর টেলিগ্রামের কোনও উত্তর দিচ্ছে না (নামেমাত্র আর্মি হেড-কোয়ার্টার্স থেকে। কী উত্তর দেবেন এরা?
লিঙে এ সময়ে হিটলারের আচরণ বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ঘন্টার পর ঘণ্টা ধরে তিনি কামরার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দ্রুতগতিতে পায়চারি করছেন, কখনও-বা ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বদ্ধমুষ্টি দিয়ে দেয়ালে করাঘাত করছেন। কেন? তার কাছে ঘরের চারখানা দেয়াল কি কারাগারের চারখানা প্রাচীরে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে।
আর পায়চারি? এটা তার প্রাচীন দিনের অভ্যাস। ঘন্টার পর ঘন্টা কেন? দিনের পর দিন। হিটলারের একমাত্র বন্ধু ফোটোগ্রাফার হফমান লিখেছেন, হিটলারের প্রথম প্রেয়সী (সকলেরই মতে এইটেই ছিল তার প্রথম এবং শেষ গ্রেট লাভ এফার প্রতি তার প্রেম ছিল অন্য ধরনের) যখন আত্মহত্যা করে মারা যান, তখন তিনি নিচের তলা থেকে হিটলারের পদধ্বনি শুনতে পান তিন দিন তিন রাত ধরে মাঝে মাঝে ক্ষান্ত দিয়ে। এই তিন দিন তিন রাত তিনি জলস্পর্শ করেননি। প্রণয়িনীর গোর হয়ে গিয়েছে খবর পেয়ে হিটলার পায়চারি বন্ধ করে সোজা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গিয়ে পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন।(৯)
আর কখনও কখনও টেবিলের উপর কনুই রেখে অনেকক্ষণ ধরে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সমুখপানে।
ভেংকের জন্য প্রতীক্ষা, তার উত্তেজনা ও জালবদ্ধ পশুর মতো ছটফটানি তার চরমে পৌঁছল ২৮ এপ্রিল। রাশানরা তখন বার্লিন নগরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে লড়াই করে করে হিটলারের বাসবনের দিকে এগিয়ে আসছে। বার্লিনের কমান্ডান্ট হিটলারকে বলে গেছেন, দু দিন, জোর তিন দিনের ভিতর রুশরা বুঙ্কারে এসে পৌঁছবে। কিন্তু ভেংক কোথায়? কী ঘটে থাকতে পারে?
নিশ্চয়ই আবার বিশ্বাসঘাতকতা! বার্লিন জয় করার মতো শক্তির শতাংশের একাংশও যে ভেংকের নেই সেকথা কে বিশ্বাস করে? ২৮শে সন্ধ্যায় বরমনি সেই সুদূর দক্ষিণ জর্মনির মনিকে তার মিত্র এডমিরাল পুটকামারকে টেলিগ্রাম করলেন, সৈন্যদের আদেশ ও অনুরোধ করে যেসব কর্তৃপক্ষ তাদের এখানে আমাদের উদ্ধার করার জন্য পাঠাতে পারতেন, তাঁরা সেটা না করে নীরব। বিশ্বাসঘাতকতা বিশ্বস্ততার স্থান অধিকার করেছে। আমরা এখানেই থাকব। ফুরার-ভবন খণ্ড-বিখণ্ড।
এক ঘণ্টা পর, বহু প্রতীক্ষার পর বাইরের জগৎ থেকে পাকা খবর এল। হিটলারকে কিছুমাত্র আভাস না দিয়ে হাইনরিশ হিমলার গ্যোরিঙের পদচ্যুতির পর এখন যিনি জর্মনির দ্বিতীয় ব্যক্তি- মিত্রশক্তির কাছে সন্ধির প্রস্তাব করেছেন, পুর্বোল্লিখিত রেসের নেতা সুইড় কাউন্ট বের্নাডট্টের মাধ্যমে। প্রস্তাবটি গোপনেই করা হয়েছিল কিন্তু কী করে কে জানে সেটা শুণ্ডিপথে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কোনও এক বেতার-কেন্দ্র সেটা প্রচার করেছে। হিটলারের বার্তা সরবরাহ বিভাগের কর্মচারী বেতারে সেটা শুনে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে স্বয়ং এসেছেন হিটলারকে মুখোমুখি খবরটা দিতে।
কামানের গোলা, বোমারুর বোমা তখন ডাল-ভাত। কাজেই ঘরের ভিতর বোমা ফাটলেও হিটলার অতখানি বিচলিত হতেন না। সেই বিশ্বাসী হাইনরিষ, যে কি না তার খাস সৈন্যদলের বেল্টে খোদাবার আদেশ দিয়েছিল– TREUE- বিশ্বস্ততা, প্রভুভক্তি, নেমকহালালি। সে কুকুর এখন ঠাকুরের আসনে বসতে চায়, তাঁর প্রতি নেমকহারামি করে? এই একমাত্র নাৎসি নেতা যার প্রভুতে অবিচল ভক্তি সম্বন্ধে কারও মনে কখনও সন্দেহ হয়নি। আর এ-কথা সকলেই জানতেন, যুদ্ধারম্ভের প্রথম দিনই হিটলার মার্শাল ল প্রচার করেছিলেন, তাঁর কোনও কর্মচারী– তা তিনি যত উচ্চপদেরই হোন না কেন- যদি কোনও সন্ধির আলোচনা করেন তবে তার প্রাণদণ্ড হবে– এ বাবদে কোনও করুণা দেখানো হবে না।
হিটলারের মুখ থেকে নাকি সবশেষ রক্তবিন্দু অন্তর্ধান করেছিল।
স্টাইনারের আক্রমণ কেন হয়ে ওঠেনি, ভেংক কেন আসছে না- এসব সমস্যা হিটলারের কাছে সরল হয়ে গেল। নিশ্চয়ই পিছনে রয়েছে হিমলারের বিশ্বাসঘাতকতা। অবশ্য ঐতিহাসিক মাত্রেই জানেন এ সন্দেহ সত্য নয়। হিমলার শেষ মুহূর্তে সন্ধির প্রস্তাব এনে শুধু আপন প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছিলেন অন্য বহু বহু নাৎসি নেতার মতো। তারা গোপনে সুইস ও দক্ষিণ আমেরিকার জর্মন বহুল নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন একাধিক রাষ্ট্রে বিস্তর অর্থ জমা রেখেছিলেন ও জাল নামে পাসপোর্ট তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন। হিমলারকে জনসাধারণ ভালো করেই চিনত; তাঁর পক্ষে এ পন্থা সম্ভবপর ছিল না।(১০)