নিষ্ঠুরতম আদেশ দেন হিটলার বরমানকে জর্মন জাতকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করার। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম থেকে আবালবৃদ্ধ নরনারীকে খেদিয়ে, সঙ্গিনের ঘায়ে, গুলি চালিয়ে জড়ো করা হোক মধ্য-জর্মনির এক মধ্য অঞ্চলে। পথে বা সেখানে আহারাদির কোনও ব্যবস্থা থাকবে না। সেখানে ও পথে আসতে আসতে তারা সবাই মরবে। এ আদেশ পালিত হয়নি। সেনাবাহিনীতে হুকুম দেবার মতো যথেষ্ট অফিসার ছিলেন না বলে, না অন্য কারণে কেউ স্পষ্টাস্পষ্টি উল্লেখ করেননি। তবে একাধিক ঐতিহাসিক বলেছেন, বাইবেল-বর্ণিত স্যামসন (স্যামসন ও ড্যালাইলা ছবি এদেশেও আসে) যে-রকম মৃত্যুবরণ করার সময় তার শত্রুদের মন্দির টেনে ভেঙে ফেলে তাদেরও মৃত্যু ঘটান, হিটলারও তেমনি ওপারে যাবার সময় কুল্লে জাতটাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
বার্লিনবাসীরা প্যারিজিয়ানদের মতো কখনও নিজেদের মধ্যে সিভিল ওয়ার লড়েনি বলে কখনও রাস্তায় রাস্তায় পিপে, পাথর, আসবাবপত্র, ভাঙা গাড়ি, মোটর দিয়ে আঁটি বা ব্যারিকেড বানাতে শেখেনি। যেগুলো বানিয়েছিল সেগুলো এতই আনাড়ি হাতে তৈরি, কাঁচা, যে তার বর্ণনা দিয়েছেন সুইডেন রাজপরিবারের কাউন্ট ফলকে বেরনাট্টে। ইনি ব্যারিকেড বানাবার সময় বার্লিনে আসেন সুইডিশ রেডক্রসের প্রতিভূ হিসেবে, তার দেশবাসী বন্দিদের জন্য মুক্তির আবেদন করতে। (৮) ওই ব্যারিকেডগুলো নিয়ে খাস বার্লিন কনিরা (ঢাকার কুট্টিদের মতো) একে অন্যের সঙ্গে মন্তব্য বিনিময় করছিল। একজন বললে, এগুলো ভাঙতে রুশদের একঘণ্টা দুমিনিট লাগবে। কীরকম? পাকা একঘণ্টা তাদের লাগবে হাসি থামাতে। আর দু মিনিট লাগবে সেগুলো ভাঙতে।
ভিন্ন ভিন্ন বুঙ্কারে প্রায় ছ-সাতশো হিটলার-দেহরক্ষী দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, বেঞ্চিতে মাটিতে ঘুমিয়ে অথবা সংখ্যাতীত টিনে রক্ষিত হ্যাম, বেকন, সসেজ (রুটির উপর এত পুরু মাখন যে বলদ ঠোক্কর খেয়ে পড়ে যাবে), মুরগি-রোস্ট আর বোতল বোতল ফ্রান্স থেকে লুট করে আনা, জর্মনির আপন উৎকৃষ্ট ওয়াইন, শ্যাম্পেন খাচ্ছে। এরা জর্মনির ঐতিহ্যগত সেনাবাহিনীর লোক নয়– তারা লড়ছে আপ্রাণ–এরা হিটলার-হিমলারের আপন হাতে তৈরি এসএস, যুদ্ধে নামবার বিশেষ আগ্রহ এদের নেই। এদের দেখে বলটু মনে মনে ভাবছেন, এরা এখানে কেন? ফুরার তথা জনির শত্রু বুস্কারের ভিতরে না বাইরে, যেখানে লড়াই হচ্ছে কিন্তু রান্নাঘরের খাস বার্লিনের কনি (কুডি) মেয়েরা স্পষ্টভাষী। হঠাৎ কয়েকজন চিৎকার করে এদের বললে, হেই, হতভাগা নিষ্কর্মার দল! তোরা যদি এখুনি বাইরে গিয়ে যুদ্ধে না নামিস তবে তোদের পরিয়ে দেব আমাদের গা থেকে মেয়েছেলেদের রান্নার সময়কার পোশাক। আর আমরা যাব লড়তে। বারো-চোদ্দ বছরের ছেলেরা প্রাণ দিচ্ছে লড়তে লড়তে, রাস্তায় আর হামদো হামদো তাগড়ারা বসে আছে এখানে!
হিটলার তাকিয়ে আছেন ভেংকের আশায়।
বুঙ্কারের এই পাগলদের দুরাশার ভিতর একটি লোকের মাথা পরিষ্কার ছিল– ইনি হিমলারের প্রতিনিধি ফেগেলাইন। কিন্তু তিনি জানতেন না, যেখানে সবাই পাগল সেখানে সুস্থ-মস্তিষ্ক হওয়া পাগলামি। ইনি মোকা বুঝে এফার (যাকে দুদিন পরে হিটলার বিয়ে করেন) বোনকে বিয়ে করে যেন হিটলার-পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলেন– আসলে সবাই একমত, লোকটা অপদার্থ। গোড়াতে ছিল রেস্-কোর্সের জকি। আঙুল ফুলে কলাগাছ, দম্ভতরে যাকে-তাকে অপমান করত– ওদিকে বরমান, বুর্গড, ক্রে তার এক গেলাসের ইয়ার। হিটলার-পরিবারের সম্মানিত সদস্য হয়েও পারিবারিক আত্মহত্যা করে পারিবারিক চিতানলে হিটলার-এফার সঙ্গে ভস্মীভূত হয়ে বৃহত্তর গৌরব সে কামনা করেনি। সোনা-জওহর নিয়ে পালাবার সময় সে ধরা পড়ল– এই সঙ্কটের সময়ও যে হিটলার সবদিকে নজর রাখতেন সেটা প্রমাণ হল যখন তিনিই প্রথম লক্ষ করলেন, ফেগেলাইন নেই। ধরার পর হিটলারের আদেশে তার ইউনিফর্ম, মেডেলাদি কেড়ে নিয়ে, পদচ্যুত করে তাকে বন্দি করে রাখা হল।
২৭ এপ্রিল দিনের শেষ রাত্রে রাশানরা যেন দৈবক্ষমতায় দিব্যদৃষ্টি পেয়ে অব্যর্থ লক্ষ্যে হিটলারের বুঙ্কারের আশেপাশে, উপরে বোমার পর বোমা ফেলতে লাগল। বুষ্কারবাসীরা জড়সড় হয়ে শুনতে পাচ্ছে যেন প্রত্যেকটি কামানের বিরাট গোলা তাদেরই মাথার উপর ফাটছে। কারও মনে আর সন্দেহ রইল না, এবার যে কোনও মুহূর্তে রুশেরা সরাসরি বুঙ্কার আক্রমণ করবে।
সে রাত্রে হিটলার তার অন্তরঙ্গজনকে নিয়ে মজলিসে বসলেন। স্থির হল, প্রথম রুশসৈন্য দেখা দিতেই পাইকারি হারে সবাই আত্মহত্যা করবেন। তার পর সবাই পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করলেন, কী প্রকারে মৃতদেহগুলোও শনাক্তের বাইরে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা যায়। তার পর একে একে প্রত্যেকে ছোট্ট ছোট্ট বক্তৃতা দিয়ে হিটলার ও জনির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন বলে শপথ নিলেন।
ব্লাফ ব্লাফ ব্লাফ! সবসুদ্ধ দুই কিংবা তিনজন প্রতিজ্ঞা পালন করেন। আর সবচেয়ে হাস্যকর হিটলারের মৃত্যুর ঘন্টা তিনেক পরেই আমিরদের পয়লা নম্বরি বরমান চার নম্বরি কেবৃকে পাঠালেন রুশদের কাছে সন্ধি-স্থাপনার্থে! সেটা বানচাল হয়ে গেলে দুজন ছাড়া সবাই চেষ্টা করলেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে, বরমান একটা ট্যাঙ্কে চড়ে– এটার ব্যবস্থা তিনি শপথ নেবার পূর্বেই করেছিলেন নিশ্চয়– রুশ-ব্যহ এড়িয়ে, তখনও অপরাজিত উত্তর জৰ্মনিতে ড্যোনিৎসের (হিটলার মৃত্যুর পূর্বে এঁকেই রাষ্ট্রের প্রধান রূপে নির্বাচিত করে যান) সঙ্গে যোগ দিতে। যারা অক্ষম হয়ে মার্কিনদের হাতে বন্দি হলেন তারা তখন প্রতিদ্বন্দিতা আরম্ভ করলেন মার্কিনদের সুমুখে, কে হিটলারকে কত বেশি ঘৃণা করতেন সেইটে সাড়ম্বরে বোঝতে।