ইতোমধ্যে হিটলার গ্যোবেলস্ দম্পতিকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তারা যেন তাদের বাসস্থান ত্যাগ করে তাদের দুটি বাচ্চাসহ তার পাশের বুঙ্কারে বাসা বাঁধেন। সুবুদ্ধিমান হাতুড়ে ডাক্তার মরেল ইতঃপূর্বেই চোখের জল ফেলতে ফেলতে (কেউ কেউ বলেন চোখের জল ফেলে অনুনয় করে, অন্যেরা বলেন কুমিরের ভণ্ডা) হিটলারের কাছ থেকে বিদায় ভিক্ষা করে দূর দক্ষিণে কেটে পড়েছেন (হিটলার যেন ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, যে পথে যাচ্ছি সেখানে যাবার জন্যে আপনাকে আমার আর প্রয়োজন নেই)। তাঁর কামরা ছিল বুঙ্কারে হিটলারের মুখোমুখি– গ্যোবেলস্ সে ঘরটাও পেলেন। গ্যোকে দম্পতি ও হিটলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে বসলেন। গ্যোবে বললেন তিনিও আত্মহত্যা করবেন, এবং হিটলারের আপত্তি সত্ত্বেও ফ্রাই গ্যোবেল বললেন, তিনিও সেই পথ ধরবেন এবং বাচ্চা ছটিকে বিষ খাইয়ে মারবেন।
এটা এমনি বীভত্স কাও যে কোনও ঐতিহাসিকই এ নিয়ে মন্তব্য করেননি। এর পর হিটলার তার কাগজপত্র থেকে নিজে বাছাই করে কতকগুলি পোড়াবার আদেশ দিলেন।
সমস্ত দিন ধরে দক্ষিণ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ, উত্তর থেকে নৌসেনাপতি ড্যোনিস ও হিমলার এবং আরও একাধিক আমির হিটলারকে বার্লিন ত্যাগ করতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন, কিন্তু হিটলার অটল অচল। ২৩ তারিখে তিনি জেনারেল কাইটেলকে পশ্চিম রণাঙ্গনে পাঠিয়েছেন জেনারেল ভেংকের কাছে তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে বার্লিন উদ্ধার করবেন। ইতোমধ্যে রাশানরা বার্লিন মাঝখানে রেখে সাড়াশি বৃহ নির্মাণের জন্য বার্লিন ছাড়িয়ে পশ্চিম দিকে পঞ্চাশ মাইল এগিয়ে গিয়েছে। ভেংককে এদের সঙ্গে লড়াই করে করে তবে বার্লিনে পৌঁছতে হবে। হিটলার ঘড়ি ঘড়ি খোচ্ছন, ভেংকের খবর কী, তিনি কতদূর এগিয়েছেন! সমস্ত বুঙ্কারবাসীর ওই এক শেষ ভরসা। কিন্তু তার কোনও খবর নেই।
২৫ তারিখে রুশসৈন্য সমস্ত বার্লিন চক্রব্যুহ ঘিরে ফেলল। এর পর আর দশ-বিশজন লোক যে একসঙ্গে বার্লিন থেকে বেরুবে তার উপায় আর রইল না। তবে একজন দুজন গলিঘুচি দিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে রাতের অন্ধকারে হয়তো বেরুতে পারে। এ অবস্থায় হিটলারকে বার্লিন ত্যাগ করার জন্য আর অনুরোধ করা যায় না।
কিন্তু বুঙ্কারে দিনে দু-বার কখনও-বা তিনবার হিটলার তার মন্ত্রণাসভায় নেতৃত্ব করে যেতে লাগলেন। সেখানে শুধু ওই খবরই পাওয়া যেত, রুশরা বার্লিনের কোন দিকে কতখানি ভিতরে ঢুকে পড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় বৃদ্ধ আর বারো থেকে ষোল বছরের ছেলেরা যতখানি পারে লড়াই দিচ্ছে। যে-কোনও সেনানীর পক্ষেই কোনও শহরের অন্তর্ভাগ দখল করা সহজ নয়। রুশরা এগুচ্ছে ধীরে ধীরে, অতি সাবধানে। ইতোমধ্যে পূর্ব থেকে এসে রুশসৈন্য ও পশ্চিম থেকে এসে মার্কিন সৈন্য মধ্য-জর্মনিতে হাত মিলিয়েছে– জর্মনি এখন দু খণ্ডে বিভক্ত। উত্তর থেকে বার্লিন থেকে এখন আর আলপসের গিরি-উপত্যকায় গিয়ে যুদ্ধ প্রলম্বিত করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
দুই সেনাবাহিনীর এই হাত মেলানোর খবর হিটলার পেলেন মন্ত্রণাসভায় বসে। সংবাদদাতা বললেন, দু দলে কথা-কাটাকাটি হয়েছে। ফুরারের পাংশু মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, চোখের জ্যোতি যেন হঠাৎ ফিরে এল। সোল্লাসে বললেন, আমি কি তখনই বলিনি? এইবারে রু হবে। কিন্তু হায়, পরের দিনই খবর এল, দু দল শান্তভাবে আপন আপন থানা গড়ে নির্বিরোধে খবর পরামর্শ লেন-দেন করছে।
বার্লিনের অবস্থা অবর্ণনীয়। অষ্টপ্রহর উপর থেকে বোমাবর্ষণ এবং তার সঙ্গে এসে জুটেছে শহরের উপকণ্ঠে বিরাট বিরাট কামান। বোমা ফেলছে বুঙ্কারের উপর। স্তালিনগ্রাদে যেসব জর্মন ধরা পড়েছিল তাদের অনেকে মিলে হিটলার-বিরোধী এক স্বাধীন-জর্মনি দল গড়ে। এরাই আজ রুশদের বার্লিনের রাস্তাঘাট, বাড়ি-ঘর চিনিয়ে দিচ্ছে। তাই তাগেও ভুল হচ্ছে না। বুঙ্কারে ফাটল ধরেছে। শহরের কোনও জায়গায় যদি অগ্নিপ্রজ্বালক বোমায় আগুন ধরল তবে সে আগুন জলের অভাবে নেভানো যায় না বলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যতক্ষণ না পূর্বের থেকে পুড়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় পৌঁছয় ততক্ষণ সে ব্লকের পর ব্লক, রাস্তার পর রাস্তা পুড়িয়ে চলে। ভূগর্ভস্থ সেলারে লক্ষ লক্ষ আহত সৈনিক গোঙরাচ্ছে, শিশুরা কাঁদছে। ক্ষুধার চেয়ে তৃষ্ণা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বোমা পড়ে কোনও কোনও জায়গায় জলের পাইপ ফেটে পূর্বে যে জল জমেছিল মেয়েরা সেই ঘোলাটে জল বালতিতে করে নিয়ে যাচ্ছে।
খবর এল রাস্তায় রাস্তায় লড়ে লড়ে রুশসৈন্যরা তো এগুচ্ছেই, সঙ্গে সঙ্গে তারা ভূগর্ভস্থ রেলপথের (আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে) টানেল দিয়ে এগিয়ে আসছে। হিটলার হুকুম দিলেন স্প্রে নদীর (কানাল বা বড় খালও বলা হয়) জল বন্ধ করার গেট খুলে দিতে। সে জল রুশদের ডুবিয়ে মারবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মরবে হাজার হাজার আহত জর্মন সৈনিক– যারা মাটির নিচের স্টেশন-প্লাটফর্মে শুয়ে শুয়ে অচিকিৎসায় মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে। এদের জীবন-মরণে হিটলারের ভুক্ষেপ নেই। বলট বলেছেন, সমস্ত যুদ্ধে এরকম হৃদয়হীন আদেশ তিনি শোনেননি। (এ আদেশ পালিত হয়েছিল কি না আমি জানিনে)।
এর চেয়েও নিষ্ঠুর আদেশ হিটলার বরমানকে পূর্বেই দিয়ে বসে আছেন। যে শহরের সামনে শত্রুসৈন্য দেখা দেবে তার তাবৎ কারখানা, ওয়াটার-ওয়ার্ক, বিজলি, নদীর উপর সেতু সব যেন উড়িয়ে দেওয়া হয়। সরবরাহ মন্ত্রী স্পের আপত্তি জানিয়ে বললেন, যুদ্ধের পরে জর্মনরা তবে গড়বে কী, বাঁচবে কী দিয়ে? হিটলার বললেন, এ যুদ্ধে সপ্রমাণ হয়েছে জর্মন জাত রুশের তুলনায় অপদাথ; এদের পক্ষে মৃত্যুই শ্রেয়। স্পের কিন্তু গোপনে এ আদেশ বানচাল করে দেন।