আর ইনজেকশনের তো কথাই নেই : লেকচার দিতে হলে পূর্বে ইনজেকশন, পরে ইনজেকশন। প্রকৃতি অসুস্থ মানুষকে সুস্থ হতে সাহায্য করে; মরল বা হিটলার সে সাহায্য নিতে চাইতেন না। ফলে প্রকৃতির প্রতিশোধও শেষ বয়সে নির্মমভাবে তার প্রাপ্য নেয়।
ডাভাররা যখন হিটলারকে এ তথ্যটি বললেন, তখন তিনি রেগে টং। মরেলের ওপর না, ডাক্তারদের ওপর।
হিটলার তাদের অকথ্য অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। তার বক্তব্য, মরেলের কড়ে আঙুলের যত এলেম, এদের গুষ্টির সবকটার মগজেও তা নেই।
ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫ সালে বলট মিলিটারি রিপোর্ট দিতে গিয়ে তাকে জীবনের প্রথমবারের মতো কাছের থেকে দেখেন। হিটলার অনেকখানি কুঁজো হয়ে, বাঁ-পা হেঁচড়ে টেনে আনতে আনতে আমার দিকে এগিয়ে এসে করমর্দন করতে হাত বাড়িয়ে দিলেন। মর্দনের সময় নির্জীব হাত কোনও চাপ দিল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন তার চোখে এক অবর্ণনীয় কাঁপা-কাঁপা জ্যোতি(৬) সম্পূর্ণ অনৈসর্গিক এবং ভীতিজনক। তার বা-হাত নিস্তেজ হয়ে ঝুলে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। তার মাথাও অল্প অল্প দুলছে। তার মুখ ও বিশেষ করে চোখের চতুর্দিকে দেখলে মনে হয় যেন এগুলোর সব শেষ হয়ে গেছে। সবসুদ্ধ মিলিয়ে মনে হয়, লোকটি অতিশয় বৃদ্ধ।(৭)…অন্যরা বলেছেন, নানারকমের বিষাক্ত ওষুধ খেয়ে খেয়ে তার চামড়ার রঙ বিবর্ণ পাটে হয়ে গিয়েছিল। তার বাঁ-হাত এত বেশি কাপত যে চেয়ারের হাতা বা টেবিল তিনি সে হাত দিয়ে চেপে ধরতেন; দাঁড়ানো অবস্থায় দু-হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে ডান-হাত দিয়ে বাঁ-হাত চেপে ধরে রাখতেন।… বল্টু হিটলারের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পূর্বে আবার তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি আরও কুঁজো হয়ে গিয়েছেন, আরও পা টেনে টেনে আস্তে আস্তে এগোন। সমস্ত চেহারাটা মৃত। সবসুদ্ধ শীর্ণ-জীর্ণ বিকৃত-মস্তিষ্ক অতি বৃদ্ধের মূর্তি। চোখেও সেই অস্বাভাবিক জ্যোতি আর নেই।
হিটলার যখন দৃঢ়কণ্ঠে বার্লিনেই মৃত্যুবরণের শপথ গ্রহণ করলেন তখন সকলেই একবাক্যে আপত্তি জানিয়ে বললেন, নিরাশ হবার মতো কিছুই নেই। দক্ষিণ জর্মনি ও উত্তর ইতালিতে, বোহেমিয়া অঞ্চলে ও অন্যত্র এখনও অনেক অক্ষত সৈন্যবাহিনী রয়েছে। হিটলার যদি দক্ষিণ জর্মনির গিরি-উপত্যকায় তাদের জড়ো করেন তবে আরও অনেকদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করা যাবে।
হিটলার অচল অটল। তার হুকুমে পরের দিন বার্লিন বেতার প্রচার করল, হিটলার, গোবে ও পার্টির কর্মকর্তাগণ বার্লিন ত্যাগ করবেন না, ফুরার স্বয়ং বার্লিন রক্ষা করবেন। তার পরের কথাগুলো বোধহয় গ্যোবেসের জোড়া প্রপাগান্ডা-বাণী বার্লিন ও প্রাগ চিরকাল জর্মন শহর হয়ে রইবে। কাইটেল, ইয়োডল বরমানকে ডেকে বললেন, আমি বার্লিন ত্যাগ করব না। জেনারেলয় প্রতিবাদ করে বললেন, তা হলে দক্ষিণ জর্মনির জমায়েত সৈন্যচালনা করবে কে? হিটলার বললেন, সৈন্যচালনার কীই-বা আছে, লড়াইয়ের কীই-বা বাকি। এখন সন্ধিসুলেহ কর গে। সে কাজ গ্যোরিঙই আমার চেয়ে ঢের ভালো পারবে।
গ্যোরিঙের এই উল্লেখ পরবর্তী অনেক ঘটনার জন্য দায়ী।
২৩ এপ্রিল দুপুরবেলা দক্ষিণ জর্মনিতে গ্যোরিঙের কাছে এই কথোপকথনের খবর পৌঁছল। তিনি যে খুশি হলেন সেটা কারও বুঝতে অসুবিধা হল না। তবু সাবধানের মার নেই বলে হিটলারের আইন-উপদেষ্টাকে ডেকে পাঠিয়ে ১৯৪১ সালের হিটলার-দত্ত সেই পুরনো প্রত্যাদেশের দলিল বের করলেন যেটাতে হিটলার তাঁকে তাঁর ডেপুটিরূপে নিয়োগ করেছিলেন। এখন যদি রিপোর্ট সত্য হয় যে হিটলার আর কোনও হুকুম দিচ্ছেন না, এবং সন্ধিসুলেহ করার জন্য তাকেই স্মরণ করে থাকেন তবে তাকে কিছু একটা করতে হয়। পারিষদদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ করার পর তিনি হিটলারকে তার পাঠালেন, আপনি যখন বার্লিনে শেষ পর্যন্ত থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। তবে কি আপনি ১৯৪১-এর প্রত্যাদেশ মোতাবেক রাজি আছেন যে আমি তাবৎ রাইষের নেতৃত্ব গ্রহণ করি? আজ রাত দশটার ভিতর কোনও উত্তর না পেলে বুঝব, আপন কর্ম-স্বাধীনতা থেকে আপনি বঞ্চিত হয়েছেন এবং তদনুযায়ী দেশের-দশের মঙ্গলের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করব। আপনি জানেন, আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বময় এই মুহূর্তে আপনার জন্য আমার হৃদয়ে কী অনুভূতি হচ্ছে! ভগবান আপনাকে ইত্যাদি ইত্যাদি (তার পর আশীর্বচন, মঙ্গল কামনা, অন্যান্য দরদী বাৎ)।
অত্যন্ত আইনসঙ্গত সহৃদয় চিঠি। কিন্তু গ্যোরিঙের জাতশত্রু জানের দুশমন সেক্রেটারি বরমান বছরের পর বছর ধরে এই মহাভ লগনের জন্য প্রহর গুনছিলেন। দিন হিটলার শুধু নেমকহারাম, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক সব দলকে দল এইসব বুলি আওড়েছেন; যখন তিনি উত্তেজনার চরমে হাঁপাচ্ছেন তখন বরমান গুঁড়িগুড়ি টেলিগ্রামখানা এগিয়ে দেবার সঙ্গে মৃদুকণ্ঠে এটাও যে আরেকটা বিশ্বাসঘাতকতা, হিটলার উট সঙ্কটে অসহায় জেনে এ শুধু গ্যোরিঙের নিছক শক্তি কেড়ে নেওয়ার নীচ-হীন ষড়যন্ত্র এবং এটা তারই নির্লজ্জ আলটিমেটাম (ভীতিপ্রদর্শনের সঙ্গে ম্যাদ)– একথাটিও বললেন।
হিটলার তখন চতুর্দিকে দেখেছেন বিশ্বাসঘাতকতা; এটা তারই আরেক নেমকহারাম নিদর্শন এই অর্থেই সেটা গ্রহণ করলেন। তীব্র কর্কশ কণ্ঠে গ্যোরিঙকে দিলেন অশ্রাব্য গালাগাল। বেবাক ভুলে গেলেন, তারই মুখে বেরিয়েছিল গ্যোরিঙ সম্বন্ধে প্রস্তাব, কিন্তু বরমান যখন গ্যোরিঙের প্রাণদণ্ডাদেশ চাইলেন তখন তিনি পার্টি এবং ফুরারের প্রতি গ্যোরিঙের পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও সেবা ভুলতে না পেরে আদেশ দিলেন, তাঁকে তাঁর সর্ব-পদ সর্বক্ষমতা থেকে পদচ্যুত করা হল, এবং আদেশ দেওয়া হল হিটলারের পর তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন না। এবং তাকে গ্রেফতার করে বন্দি করে রাখার হুকুম দেওয়া হল।