বুঙ্কারে হিটলারের জীবনের শেষ কদিন সম্বন্ধে যারা লিখেছেন তারা অনেক ক্ষেত্রে সময় ও তারিখে ভুল করেছেন। কারণটি অতিশয় সরল। দিনের পর দিন এরা বিজলি বাতিতে কাজ করেছেন মাটির পঞ্চাশ ফুট নিচে। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত কিছুই দেখতে পাননি। তারিখ ঠিক থাকবে কী করে? মাঝে মাঝে তারা প্রায় ভিরমি যেতেন। বাইরের বিশুদ্ধ বাতাস কলের সাহায্যে বুঙ্কারে ঠেলে দেওয়া হত। কিন্তু বোমাবর্ষণের ফলে বাইরের আকাশে মাঝে মাঝে এত ধুলোবালি জমে যেত যে কল সেগুলোও বুঙ্কারের ভিতর পাঠাত। বাধ্য হয়ে কিছুক্ষণের জন্য কল বন্ধ করে দিতে হত। ফলে অক্সিজেনের অভাবে সবাই নিরুদ্ধনিম্বাস। বুঙ্কারের ভিতরকার অনৈসর্গিক দৃষিত বাতাবরণের দৈহিক ও মানসিক উভয়ই সর্বোত্তম বর্ণনা দিয়েছেন হার বলুট, একখানা চটি বইয়ে। ট্রেভার তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করেছেন। অমূল্য চটি বইখানার অনুবাদ নিশ্চয়ই হয়েছে কিন্তু সেটি আমার চোখে পড়েনি আমি উপকৃত হয়েছি বলে পাঠককে পড়তে বলছি। শুনেছি, বইখানা নাকি দক্ষিণ আমেরিকায় আইষমানের লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়, এবং ক্রোধোন্মত্ত আইষমান নাকি মার্জিনে লিখেছেন- ব্যাটাকে যদি একবার পেতুম!(৩)
পূর্বোল্লিখিত আক্রমণের যে আদেশ হিটলার তার জন্মদিনের পরের দিন, ২১ এপ্রিল দিলেন তার সেনাপতি নিযুক্ত হলেন স্টাইনার।
পরের দিন সকালবেলা (হিটলার শুতে যেতেন ভোরের দিকে আর উঠতেন দুপুরের দিকে। শেষের দিকে দুর্ভাবনা আর ভগ্নস্বাস্থ্যের দরুন শুতে যেতেন আরও দেরিতে, উঠতেনও তাড়াতাড়ি, তিন ঘণ্টারও বেশি ঘুম হত না) থেকে হিটলার স্বয়ং এবং তার হুকুমে অন্যরা চতুর্দিকে ফোন করতে লাগলেন, স্টাইনারের আক্রমণ কতদূর এগিয়েছে। কেউই কোনও পাকা খবর দিতে পারে না। যেটুকু আসছে তা-ও পরস্পরবিরোধী; একবার স্বয়ং হিটলার বললেন তিনি অবশ্য অকুস্থল থেকে দূরে আক্রমণ চলছে; তার পরমুহূর্তেই অন্য সূত্র থেকে খবর এল আক্রমণ আদপেই আরম্ভ হয়নি। এমনকি স্টাইনার স্বয়ং যে কোথায় তা-ও কেউ সঠিক বলতে পারে না। যে জেনারেল কলারের মুণ্ডুর ভিতর গিয়ে গরম বুলেট চালিয়ে দেবার ভয় দেখানো হয়েছিল তিনি তাঁর রোজনামচায় সেই ধুন্ধুমারের বর্ণনা লিখেছেন–এবং সেটি প্রকাশিত হয়েছে।
বিকেল তিনটে পর্যন্ত কোনও খবর নেই। তার পর নিত্যিকার প্রথামতো মন্ত্রণা-সভা বসল। উপস্থিত ছিলেন ফুরার, দুই জেনারেল কাইটেল (হিটলারের পরেই তিনি) ও তার পরে জন ইয়োডল; এবং আরও দুই সেনাপতি বুৰ্গডফ (পাঁড়মাতাল) ও ক্রেবস্– শেষের দুজন সদাসর্বদা হিটলারের পাশের বুঙ্কারে বাস করতেন ও বলতে গেলে হিটলারের লিয়েজোঁ অফিসার ছিলেন এবং হিটলারের সেক্রেটারি বরমান।(৪)
সেই ঐতিহাসিক মন্ত্রণাসভায় হিটলার-রাইষের শেষ হাঁড়ি ফাটল।
স্টাইনার-আক্রমণ আদৌ ঘটেনি। একখানি বোমারু বা জঙ্গিবিমানও আকাশে ওঠেনি। হিটলারের পুত্থানুপুঙ্খ প্ল্যান, মুণ্ডু দিয়ে বুলেট চালানোর বিভীষিকা প্রদর্শন– সব ভণ্ডুল, সব নস্যাৎ!
তার জীবনে এই প্রথমবারের মতো হিটলার পরাজয় স্বীকার করলেন।
হিটলারের মেজাজটি ছিল আগুনে গড়া। দুঃসংবাদ পেলেই তিনি চিৎকার করে উঠতেন কর্কশ কঠে, চিল্কারে চিল্কারে তার গলা কেটে যেত, পায়চারি না- ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত সবেগে ছুটোছুটি আরম্ভ করতেন, মুখ দিয়ে ফেনা ফেরুতে আরম্ভ করত, এবং চোখদুটো যেন কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইত। প্রধান প্রধান সেনাপতিদের মুখের সামনে ঘুষি বাগিয়ে কাপুরুষ, বিশ্বাসঘাতক পর্যন্ত বলতে কসুর করতেন না। বেদরদীরা বলে, তিনি শেষ পর্যন্ত মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে দিতে কার্পেট চিবুতে আরম্ভ করতেন তাই তারা তার নামকরণ করে কার্পেটভুক। তবে সত্যের খাতিরে বলা ভালো, হিটলারের শত্রু-মিত্র কোনও ঐতিহাসিকই এটা বিশ্বাস করেননি।
এবারে শুধু যে তাই হল নয়, এবার চিৎকার, হুঙ্কার, বেপথুর পর তিনি নির্জীবের মতো চেয়ারে বসে স্বীকার করলেন, এই শেষ। কুশের তুলনায় জর্মন জাতি হীনবল, নির্বীর্য, অপদার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার মতো লোককে তাদের ফুরাররূপে পাবার গৌরব ও সামর্থ্য তারা ধরে না। তার মনে আর কোনও দ্বিধা নেই, তিনি দক্ষিণ জর্মনি গিয়ে আপসের গিরি-উপত্যকার গুহাগরে যুদ্ধ চালাবেন না– তৃতীয় রাষ্ট্র বন্ধ্যা সপ্রমাণ হয়ে গিয়েছে। তিনি বার্লিনেই থাকবেন। সম্মুখযুদ্ধ করার মতো শারীরিক শক্তি তার আর নেই বলে রুশরা বার্লিন প্রবেশ করলে তিনি বার্লিনের রাস্তায় বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রাণ দিতে পারবেন না। তিনি তখন আত্মহত্যা করবেন।
একথা সত্য, হিটলারের শরীরে তখন আর কিছু নেই।
হিটলারের অন্যতম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাসেলবাখ বলেন, ১৯৩৯ পর্যন্ত হিটলারকে তাঁর বয়সের তুলনায় (তখন তিনি ৫০) অনেক কম দেখাত। ওই সময় থেকে তিনি অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বুড়োতে লাগলেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত ভার যা সত্যকার বয়স তাই দেখাত। ১৯৪৩-এর (স্তালিগ্রাদের পরাজয়ের পর তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বাস্থ্য যে একেবারে ভেঙে পড়ে তার জন্য অংশত তার হাতুড়ে ডাক্তার মরেলই দায়ী হিটলারকে যেসব গণ্যমান্য চিকিৎসক পরীক্ষা করেছেন, কিংবা সাময়িকভাবে চিকিৎসা করেছেন তারা সকলে একবাক্যে এ সত্যটি বলে গেছেন। হিটলার কার্যক্ষম থাকবার জন্যে সামান্যতম সর্দিকাশিতে পর্যন্ত তিনি ভয় পেতেন, এবং আসার লক্ষণ দেখতে পেলেই অবিচারে ইনজেকশন নিতেন– মরেলের কাছ থেকে উত্তেজনাদায়ক ওষুধ চাইতেন। মরেলও অবিচারে এমন সব ওষুধ আর ইনজেকশন দিতেন যেগুলো দিত সাময়িক উত্তেজনা কিন্তু আখেরে করত স্বাস্থ্যের অশেষ ক্ষতি। বুঙ্কারে সাময়িকভাবে থাকাকালীন অন্য এক ডাক্তার দৈবযোগে হিটলারের চাকর লিঙের ড্রয়ারে এসব ওষুধ প্রচুর পরিমাণে পান ও বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ওগুলোতে মারাত্মক বিষ রয়েছে, যেগুলো অতি অল্প ডোজে কঠিন ব্যামোতে দেওয়া হয়। অথচ মরেল ওগুলো লিঙেকে দিয়ে রেখেছিলেন, হুজুর যাতে যখন খুশি, যত খুশি ওইসব ট্যাবলেট খেতে পারেন।(৫)