কারণ হিটলার একাদিক্রমে বার বার তার সহচরদের বলেছেন : আপনারা নিশ্চিন্তু থাকুন, এই যে রুশ, মার্কিন, ইংরেজ মৈত্রী এটা কিছুতেই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এদের আদর্শ স্বার্থ ভিন্ন ভিন্ন। দুই সৈন্যদল মুখোমুখি হতেই এই কোয়ালিশন (মৈত্রী) ভেঙে পড়বে। ফ্রেডরিক দ্য গ্রেটের বিরুদ্ধে ঠিক এইরকমই কোয়ালিশন হয়েছিল। তিনিও নিরুপায় হয়ে যখন আত্মহত্যার চিন্তা করছেন, ঠিক সেই সময় কোয়ালিশনের অন্যতম প্রধান নেত্রী রাশার মহারানি মারা গেলেন। রাশানরা বাড়ি ফিরে গেল; সঙ্গে সঙ্গে কোয়ালিশন খানখান হয়ে গেল। জনি লুপ্তগৌরব ফিরে পেল এবং উচ্চতর শিখরে আরোহণ করল।
বুঙ্কারের খাস কামরায় নৌসেনাপতি ড্যোনিস, জেনারেল কাইটেল, জেনারেল ইয়োডলের কাছ থেকে হিটলার একজন একজন করে জন্মদিনের অভিনন্দন গ্রহণ করলেন। বাদবাকিরা– গ্যোরিঙ, রিবেট্রপ, হিমলার (হিটলার এরই মারফত আইষমানকে ইহুদি-হননে নিযুক্ত করেন), গ্যোবেলু, বরমান ইত্যাদির সঙ্গে করমর্দন করলেন। তার মুখে ফুটে উঠেছে আত্মবিশ্বাস। তিনি দৃঢ়নিশ্চয়, বার্লিন মহানগরের সামনে রাশানরা পাবে তাদের চূড়ান্ত পরাজয়। ভাগ্যবিধাতাই শুধু জানেন, এইসব অপদার্থ চাটুকারদের কজন হিটলারের এই অন্ধবিশ্বাসে অংশীদার ছিলেন। কারণ এরা সবাই জানতেন, প্রায় সপ্তাহখানেক পূর্বে রাশার জারিনার (মহারানির) মতো প্রেসিডেন্ট রোজভেন্ট মারা গিয়েছেন, কিন্তু মার্কিন সৈন্যদল স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেনি।
হিটলার আগের থেকেই জনিকে উত্তর দক্ষিণ দু ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিলেন। এখন আদেশ দিলেন, বার্লিনে যাদের নিতান্তই কোনও প্রয়োজন নেই তারা হয় উত্তর, নয় দক্ষিণ পানে চলে যাবেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আমির-ওমরাহ দক্ষিণ ভাগে চললেন– বিরাট বিরাট লরিতে করে দফতরের কাগজপত্র বোঝাই করে, এবং তার চেয়েও বড় কথা– আপন আপন ধন-দৌলত বোঝাই করে। পড়ে রইল বার্লিনের অসহায় লক্ষ লক্ষ নরনারী। আর রইলেন খাঁটি প্রভুভক্ত গ্যোবেলস, ক্ষমতালোভী সেক্রেটারি বরমান হিটলারের গরবে তিনি গরবিনী; দূরে চলে গেলে সে শক্তি পাবেন কোথা থেকে? বাদবাকিদের অধিকাংশের সঙ্গে হিটলারের আর দেখা হয়নি। তার দুই প্রধান সেনাপতি কাইটেল আর ইয়োডল গেলেন বার্লিনের উপকণ্ঠে, সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সে; নৌসেনাপতি চলে গেলেন উত্তর-পশ্চিম সমুদ্র-পারে, তার হেডকোয়ার্টার্সে।
সবাই করজোড়ে হিটলারকে নিবেদন করলেন, আর কয়েকদিনের মধ্যেই রুশ সৈন্য বার্লিনের চতুর্দিকে ব্যহ স্থাপন করে ফেলবে। ফুরার তা হলে আর দক্ষিণে যেতে পারবেন না। যুদ্ধচালনার হুকুম-নির্দেশ তা হলে দেবে কে? হিটলার কিন্তু কিছুতেই মনস্থির করতে পারছেন না। অবশ্য একথা সবাই জানতেন, একবার মনস্থির করার পর হিটলার অচল অটল হয়ে রইতেন।
তার পর হিটলার হুকুম দিলেন, বার্লিনে ও বার্লিনের চতুর্দিকে যেসব সৈন্য রয়েছে তারা যেন সবাই একত্র হয়ে একজোটে সব ট্যাংক, সব জঙ্গিবিমান নিয়ে বার্লিনের দক্ষিণভাগে রুশসৈন্যদের আক্রমণ করে। হিটলার হুঙ্কার দিয়ে বললেন, কোনও সেনাধ্যক্ষ যদি তার সৈন্যকে সম্মুখযুদ্ধে না পাঠায় তবে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সে বাঁচবে না। জঙ্গিবিমানের সেনাপতি কলারকে বললেন, তোমার মাথার দিব্যি, কোনও সৈন্য যদি রণাঙ্গনে না যায়…। এস্থলে মাথার দিব্যি অর্থ হিটলার তার মুণ্ডুটির ভেতর দিয়ে পিস্তলের গুলি চালাবার হুকুম দেবেন।
কিন্তু হায়, বাস্তব জগতের সঙ্গে হিটলারের হুকুমের কোনও সাদৃশ্য তখন আর ছিল না। মাসের পর মাস ধরে তার আমির-ওমরাহ তাঁর কাছে সত্য গোপন করে চলেছেন। যারা সত্য গোপন করেননি, তাঁদের মধ্যে যারা অশেষ ভাগ্যবান, তারা সুদ্ধ অপমানিত লাঞ্ছিত হয়ে বরখাস্ত হয়েছেন, অন্যরা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, কারাগারে ফাঁসি যাচ্ছেন বা হিটলারের বাসসেনানীর চাবুকে চাবুকে জর্জরিত হচ্ছেন। সত্য গোপন করে হিটলারকে বলা হয়নি, ব্যাটালিয়ানের পর ব্যাটালিয়ান যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে যেখানে হিটলার ভেবেছেন পুরো ডিভিশন রয়েছে, সেখানে তার এক-দশমাংশ আছে কি না সন্দেহ, তিনজন সেপাইয়ে মিলে রয়েছে একটা বন্দুক, টোটার সংখ্যা এতই সীমাবদ্ধ যে শত্রু দশবার গুলি ছুড়লে এরা একবার; হিটলার জানতেন যে জঙ্গিবিমানের পেট্রল কমে আসছে, কিন্তু তারই অভাবে যে শত শত অ্যারোপ্লেন মাটিতেই শত্রুর বোমারু দ্বারা বিনষ্ট হচ্ছে তার পুরো খবর তাকে দেওয়া হয়নি।
বুঙ্কারের কনফারেন্স রুমে টেবিলের উপর বিরাট জঙ্গি ম্যাপ খুলে হিটলার তার কাল্পনিক সৈন্যবাহিনী, ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি লাল-নীল রঙিন বোতামের প্রতীক দিয়ে সাজাচ্ছেন আর কোন জায়গা থেকে কোন সৈন্যদল কোথায় কার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কোন জায়গায় আক্রমণ করবে তার হুকুম দিচ্ছেন। এসব সেনাপতিদের এমনকি কোনও কোনও স্থলে কর্নেলদের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করার কথা– এ সমস্ত তিনি তুলে নিয়েছেন আপন স্কন্ধে। হুকুম দিচ্ছেন মাটির নিচের বুঙ্কারে বসে। যুদ্ধের শেষের দিকে মার্কিন ইংরেজ বোমারু, জঙ্গিবিমান জর্মানির আকাশে একচ্ছত্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং দিন নেই, রাত্রি নেই বেধড়ক বোমা ফেলে ফেলে বার্লিন শহরটাকে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। হিটলার একদিনের তরে, একঘন্টারও তরে সরেজমিন অবস্থা তদন্ত করতে বেরোননি। পাছে বাস্তবতা তার অনুপ্রেরণাকে ব্যাহত করে। পক্ষান্তরে যুদ্ধের গোড়ার দিকে জর্মন বোমারু যখন লন্ডন লণ্ডভণ্ড করছিল তখন প্রায়ই দেখা যেত, বিরাট সিগার মুখে চার্চিল সেসব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর জনসাধারণকে দুঃখের দিনে উৎসাহ দিচ্ছেন– আর তারাও বলছে, আসুক না তারা, আমরাও আছি– গুড ওল্ড উইনি।(২)