এস্থলে হিটলারের পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার দম্ভ আমার নেই। উপরের কয়েক ছত্র থেকে পাঠক শুধু যেন বুঝতে পারেন আমার মিত্ররা কেন আমাকে হিটলার সম্বন্ধে প্রামাণিক পুস্তক লিখতে বলেন। আমার সেই বাসনা ছিল, কিন্তু এখন দেখছি সেটা আর হয়ে উঠবে না। তাই যেটুকু পারি সেইটুকু এইবেলা লিখে নিই।
অনেক সময় পাঠকের ধৈর্য কম থাকে বলে তিনি উপন্যাসের শেষ অধ্যায়টি পড়ে নেন। আমি শেষ অধ্যায়ই সর্বপ্রথম লিখব। পটভূমি– অর্থাৎ প্রথম বাইশ বা বত্রিশ অধ্যায় নির্মাণ করব কয়েকটি ছত্রে।
.
১৯৩৩-এ হিটলার চ্যান্সেলর হলেন। ১৯৩৪-এ জর্মনির প্রেসিডেন্ট হিডেনবুর্গ মারা গেলে তিনি সে আসনটিও দখল করে দেশের ফুরার বা একাধিপতি নেতা হন। পালিমেন্টের আর কোনও স্বাধীনতা রইল না। ১৯৩৮-এ হিটলার স্বাধীন অস্ট্রিয়া রাজ্য (তার আপন জন্মভূমি ওই দেশেই) দখল করে বৃহত্তর রাইষের অংশ করে নিলেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরেই তিনি চেকোশ্লোভাকিয়ার জন-ভাষাভাষী অঞ্চল গ্রাস করতে চাইলে, শান্তিভঙ্গের ভয়ে ভীত ইংলন্ডের চেম্বারলেন ও ফ্রান্সের দালাদিয়ে সে অঞ্চলটুকু তাকে লিখিত-পঠিতভাবে দান করলেন। কয়েক মাস পরে হিটলার চেকোশ্লোভাকিয়ার যে অঞ্চল তিনি স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন সেইটুকুও কাউকে কিছু না বলে-কয়ে গ্রাস করলেন। তখন চেম্বারলেনের কানে জল গেল– সে-ও পূর্ণমাত্রায় নয়। ১৯৩৯-এ হিটলার পোলাডের ভেতর দিয়ে জর্মন পূর্ব প্রাণী সংযুক্ত করার মানসে পোলান্ড রাজ্যের কাছে করিডর এবং অন্যান্য এটা-সেটা দাবি করলেন। ইংলন্ড আবার মধ্যস্থ হতে চাইল, কিন্তু হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করলেন। ইতঃপূর্বেই জর্মন তথা বিশ্ববাসীকে সচকিত শঙ্কিত করে তিনি তার জাতশত্রু স্তালিনের সঙ্গে চুক্তি করে পোলান্ড ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। ইংলন্ড ও ফ্রান্স তখন উত্তেজিত জনমতের চাপে পড়ে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল কিন্তু পোলান্ডকে কোনও সাহায্য পাঠাতে পারার পূর্বেই পোলান্ড হেরে গেল।
তার এক বৎসর পর ১৯৪০-এর গ্রীষ্মকালে হিটলার ফ্রান্স আক্রমণ করে অত্যল্প সময়েই তাকে পরাজিত করলেন। ফ্রান্সে আগত ইংরেজ বাহিনী প্রাণ নিয়ে কোনও গতিতে স্বদেশে ফিরে গেল। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র সাজসরঞ্জাম সবকিছু ডানকার্ক বন্দরে ফেলে যেতে হল।
হিটলার ইংরেজকে বললেন, আর কেন? সন্ধি করো? ইংরেজ বলল, না, তোমাকে খতম করব।
হিটলার তখন বিরাট নৌবহর নিয়ে ইংলন্ড আক্রমণের তোড়জোড় করলেন, কিন্তু শেষটায় দেখা গেল অভিযান নিষ্কল হলেও হতে পারে। হিটলার সে চিন্তা বর্জন করলেন।
তার চিরকালের বাসনা ছিল রুশ জয় করে বিজিত অংশে জন চাষি-মজুর বসিয়ে কলোনি নির্মাণ করা।(১) ১৯৪১-এর গ্রীষ্মে তিনি রাশা আক্রমণ করলেন ও রুশ সৈন্য পরাজয়ের পর পরাজয় স্বীকার করে পিছু হটতে লাগল। হিটলারবাহিনী মস্কোর দোরের গোড়ায় পৌঁছল। কিন্তু হিটলারের কপাল মন্দ। অসময়ে নেমে এল প্রচণ্ড শীত, বরফ আর বৃষ্টি। পরের বৎসর হিটলার-সৈন্য অভিযান করল ককেশাসের তেল দখল করতে। সেখানে স্তালিনগ্রাদে জর্মনরা খেল তাদের প্রথম মোক্ষম মার। ওদিকে হিটলারের মিত্র জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করার ফলে আমেরিকাও যুদ্ধে নামল। মার্কিনদের একদল গেল জাপানদের হারাতে; অন্য দল ইংরেজসহ উত্তর আফ্রিকায়। সেখানে রমেল প্রায় মিশর আক্রমণ করে সুয়েজ দখল করতে যাচ্ছিলেন। মার্কিন-ইংরেজ সম্পূর্ণ উত্তর আফ্রিকা দখল করে নামল জর্মনমিত্র মুসসোলিনির মুল্লুক ইতালিতে।
ওদিকে ১৯৪৪-এ রুশ বিপুল বিক্রমে জর্মনদের আক্রমণ করে বিজিত রাশা থেকে তাদের খেদিয়ে দিয়ে পৌঁছে গেল পোলাভে তার পর জর্মন সীমান্তে। এদিকে ১৯৪৪-এর গ্রীষ্মকালে হাজার হাজার জাহাজ নিয়ে মার্কিন-ইংরেজ নামল পশ্চিম ফ্রান্সের নরমাভি উপকূলে (হিটলার যে নৌ-অভিযান করতে সাহস পাননি এরা সেটাই উল্টোদিক থেকে করল)। হিটলার সমুদ্র উপকূলে প্রচুর রক্ষণ ব্যবস্থা করেছিলেন সেনাপতিদের মধ্যে রমেলও ছিলেন কিন্তু দুশমনকে ঠেকাতে পারলেন না। তারা ফ্রান্স জয় করে ১৯৪৫-এর শীতকালে জনি ঢুকে, রাইন নদ অতিক্রম করে বার্লিনের কিছু দূরে এসে দাঁড়িয়ে রইল। কারণ স্তালিনের সঙ্গে মার্কিন-ইংরেজের চুক্তি ছিল, রুশরা প্রথম বার্লিন প্রবেশ করবে। রুশরা বার্লিনের পূর্ব সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছে। এবার তারা বার্লিন আক্রমণ করবে। এটা এপ্রিলের মাঝামাঝি–১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। আর কয়েক দিন পরেই হিটলারের জন্মদিন ২০ এপ্রিল।
.
২০ এপ্রিল। আজ ফুরারের জন্মদিন। তিনি কি জানতেন, দশ দিন পর তাকে নিজের হাতে নিজের জীবন নিতে হবে না; কারণ ২৯ এপ্রিল রাত্রেও তিনি জেনারেল ভেংকের খবর নিচ্ছেন; তিনি কবে পর্যন্ত চতুর্দিকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ বার্লিন থেকে তাকে উদ্ধার করবেন। আবার ২০ এপ্রিলে ফিরে যাই।
হিটলারের আমির-ওমরাহ, সেনাপতি-জাদরেল, সাঙ্গোপাঙ্গ সেদিন সবাই জন্মদিন উপলক্ষে বুঙ্কারে উপস্থিত হয়েছেন। এদের প্রায় সকলেই মনে মনে জানতেন, ফুরারের সঙ্গে এই তাদের শেষ দেখা, কারণ রাশানরা তখন বার্লিনের প্রায় চতুর্দিকে বৃত্তাকারে ন্যূহ নির্মাণ করে ফেলেছে। যে প্রভুকে তাঁরা কেউ ১২ বছর, কেউ ২০ বছর ধরে সেবা করেছেন এবং হিটলার চ্যাসেলর হওয়ার পর ধনজন-খ্যাতি-খেতাব সবকিছুই তার অকৃপণ হস্ত থেকে পেয়েছেন তাকে তখন ত্যাগ করতে তাদের আর তর সইছে না। কারণ রাশান-বৃহ পরিপূর্ণ চক্রাকার ধারণ করার পর তারা আর বেরুতে পারবেন না। তদুপরি বার্লিনের আরও দক্ষিণে রুশ-সেনাবাহিনীর আরেক বৃহৎ অংশ রাষ্ট্রের প্রায় মাঝখানে এসেছে; মার্কিন-ইংরেজ পশ্চিম থেকে পূর্ব পানে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দুই সৈন্যদল হাত মেলালে পর রাইষ দুই খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। ২০ এপ্রিলে তারা তখনও হাত মেলায়নি-দক্ষিণ জনি পৌঁছবার জন্য তখনও একটি করিডর খোলা। বেশিরভাগই দক্ষিণ জর্মনি যেতে চান। সেখানেই নাৎসি আন্দোলনের জন্মভূমি স্যুনিক শহর; তার কাছেই হিটলারের আবাসভূমি বেহ বেটেশগাডে অঞ্চলে, আলপসের উপরে। সকলেরই বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত হিটলার ওই পর্বতসঙ্কুল গিরি-উপত্যকার গোলকধাঁধাতে এসে তারই সাহায্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য দুশমনের সঙ্গে লড়ে যাবেন–