তার পর কুড়িটি বৎসর কেটে গেলে পর ইয়োরোপের অনেক ভাষাতেই সেদিনের স্মরণে ও তার সপ্তাহখানেক পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার উপলক্ষে বহু প্রবন্ধ বেরিয়েছে।
আমার কাছে আসে প্রধানত জমনি, অস্ট্রিয়া ও সুইটজারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত জর্মন ভাষায় লিখিত সাপ্তাহিক। এগুলোর আসতে প্রায় দুমাস সময় লাগে। অ্যার-মেল হওয়ার ফলে বুকপোষ্ট, ছাপা-মাল যে কী জঘন্য শম্বুক গতিতে আসে সেকথা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।
হিটলারের মৃত্যুর পর তার সাঙ্গোপাঙ্গ অন্তর্ধান করেন। কেউ কেউ ধরা পড়েন রাশানদের হাতে। তার মধ্যে হিটলারের খাস চাকর (ভ্যালে) লিঙেও ছিলেন। কেউ কেউ লুকিয়ে থাকেন মার্কিন-ইংরেজ-ফরাসি অধিকৃত এলাকায়। এরাও ধরা পড়েন, প্রধানত মার্কিনদের দ্বারা। আর কারও কারও কোনও সন্ধানই পাওয়া যায়নি। যেমন বরমান ইত্যাদি কয়েকজন। এঁদের কে কে পালাবার সময় হত হন বা পালাতে সক্ষম হন জানা যায়নি।
গোড়ায়, অর্থাৎ হিটলারের মৃত্যুর কয়েকদিন পর রুশ জঙ্গিলাট জুকফ প্রচার করেন যে, হিটলার এফা ব্রাউনকে বিয়ে করার পর আত্মহত্যা করেন। এদিকে মস্কোতে বসে স্তালিন বলেন, হিটলার মরেননি, তিনি ডিকটেটর ফ্রাঙ্কোর আশ্রয়ে স্পেনে আছেন (স্তালিনের মতলব ছিল এই অছিলায় ইয়োরোপের শেষ ফ্যাশি ডিটেটর ফ্রাঙ্কোকে খতম করা)। এমনকি কোনও কোনও উচ্চস্থলে একথাও বলা হল যে, ইংরেজ(!) তাকে আশ্রয় দিয়েছে। ইংরেজকে তখন বাধ্য হয়ে পাকাপাকি তদন্ত করতে হয় যে হিটলার সত্যই বুঙ্কার থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন কি না, কিংবা তিনি মারা গিয়েছেন কি না। এ কাজের ভার দেওয়া হয় ইতিহাসের অধ্যাপক, যুদ্ধকালীন গুপ্তচর বিভাগের উচ্চ কর্মচারী ট্রেভার রোপারকে।
তিনি তাদেরই সন্ধানে বেরুলেন যারা হিটলারের সঙ্গে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন। এদের কয়েকজন হিটলারের মৃত্যু, দাহ, অস্থি-সমাধি পুবানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেন। কিন্তু বুঙ্কার ও তৎসংলগ্ন ভূমি তখন রাশানদের অধিকারে (পূর্ব বার্লিনে); তারা সেখানে অধ্যাপককে কোনও অনুসন্ধান করতে দিল না। হিটলারের যেসব সাঙ্গোপাঙ্গ রাশানদের হাতে ধরা পড়েন তারা যেসব জবানবন্দি দেন সেগুলোও অধ্যাপককে জানানো হল না।
হিটলারের মৃত্যুর সাত মাস পরে ট্রেলার রোপার তাঁর রিপোর্ট সরকারের হাতে দেন ও সেটি প্রকাশিত হয়। এর পর আরও তথ্য উদঘাটিত হয় বটে, কিন্তু অধ্যাপক তার ময়না-তদন্তে যে বর্ণনাটি দেন তার বিশেষ কোনও রদ-বদল করার প্রয়োজন হয়নি। এসব মিলিয়ে ট্রেভার রোপার সর্বসাধারণের জন্য একখানি পুস্তিকা রচনা করে ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত করেন। তার নাম লাস্ট ডেজ অব হিটলার।
এ পুস্তিকা ইয়োরোপের প্রায় সর্ব ভাষাতেই অনূদিত হয়, এবং তার যুক্তিতর্ক এমনই অকাট্য যে, জনসাধারণ হিটলারের মৃত্যু সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়। ওদিকে সরকারি রাশান মত–হিটলার মারা যাননি।–তাই লৌহ-যবনিকার অন্তরালে বইখানি নিষিদ্ধ বলে আইনজারি করা হল।
কিন্তু শেষটায় রাশানদের স্বীকার করতে হল যে, হিটলার জীবিত নেই। কাশীরাম দাস পূর্বেই বলে গেছেন :
কতক্ষণ জলের তিলক থাকে ভালে
কতক্ষণ থাকে শিলা শূন্যেতে মারিলে।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে স্তালিনকে প্রায় সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সৃষ্টিকর্তার আসনে তুলে দি ফ অব বার্লিন ফিলম রাশাতে তৈরি হল। এ ছবি এদেশেও এসেছিল। এতে হিটলারের মৃত্যু যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেটা মোটামুটি ট্রেভার রোপারের বর্ণনাই। মাত্র একটি বিষয়ে তফাত। ছবিতে দেখানো হয়েছে হিটলার বিষ খেয়ে মরলেন– অথচ হিটলার যে পিস্তল ব্যবহার করেছিলেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই পরিবর্তনের কারণ কী তাই নিয়ে অধ্যাপক তার পুস্তকের পরবর্তী সংস্করণে সবিস্তর আলোচনা করেছেন- এ স্থলে সেটা নিষ্প্রয়োজন। অধিকাংশ পণ্ডিতের বিশ্বাস to make assurance doubly sure হিটলার বিষের পিলে কামড় ও পিস্তলের গুলি ছোড়ন একইসঙ্গে।
রুশদেশে দশ বছর জেল খাটার পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে হিটলারের কয়েকজন পার্শ্বচর মুক্তি পান। তার ভিতর একজন হিটলারের ভ্যালে লিঙে। ইনি বেরিয়ে এসেই দীর্ঘ একটি বিবৃতি দেন। এদেশের অমৃতবাজার পত্রিকায়ও সেটি ধারাবাহিক বেরোয়। অন্যজন হিটলারের অ্যাডজুটান্ট গুশে। ইনি ও লিঙে যেসব বিবৃতি দিলেন, সেগুলোর সঙ্গে অধ্যাপকের বইয়ে গরমিল অতি কম, এবং তা-ও খুঁটিনাটি নিয়ে।
***
আমি প্রথম জমনি যাই ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে। হিটলার তখনও গোটা জর্মনিতে সুপরিচিত হননি। তার কর্মস্থল ও খ্যাতি প্রধানত ছিল মনিক অঞ্চলে। তার পর আমার চোখের সামনেই তিনি রাইটাগে (জর্মন পার্লিমেন্টে) তার দলের ক্ষমতা অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ালেন। ১৯৩২-এ আমি দেশে ফিরে এলুম। ৩৩-এ হিটলার জনির চ্যানসেলর প্রধানমন্ত্রী, প্রধান কর্মকর্তা হলেন। ১৯৩৪-এ আমি আবার প্রায় এক বছর জর্মনিতে ছিলুম। তখন হিটলার কীভাবে রাজ্যশাসন করেন সেটি পুরোপুরি দেখলুম। ১৯৩৮-এ আমি আবার জৰ্মনিতে চার মাস কাটালুম। চেম্বারলেন তখন হিটলারের কাছে যাবার জন্য তোড়জোড় করছেন। ১৯৩৮-এর সেপ্টেম্বরে হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগল। বিশ্বযুদ্ধের পর আমি হিটলার ও তার রাজ্যশাসন (থার্ড রাইষ একেই বলা হয়, এবং হিটলার সদম্ভে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তৃতীয় রাইষ, এক হাজার বছর স্থায়ী হবে–কিন্তু তার আয়ুষ্কাল হল মাত্র বারো বছর তিন মাস!) সম্বন্ধে শত শত বই কিনি। জর্মন, মার্কিন, ফরাসি, ইংরেজ ইত্যাদির লেখা। এদের সকলেই হয় হিটলারের পক্ষে না হয় বিপক্ষে ছিলেন। আমাকে নিরপেক্ষ বলা যেতে পারে। যুদ্ধের পরও আমি দু-বার জর্মনি ঘুরে আসি।