আমি শুধু হিটলারের গোর দেওয়ার পরের একটি ঘটনা উল্লেখ করব। আনাড়ি হাতে হিটলার-এফার শবদেহ পোড়ানোর অপটু প্রচেষ্টা যথেষ্ট বীভৎস, এটা বীভৎস ও নিষ্ঠুর।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সেই রাত্রেই বুস্কারবাসীর পক্ষ থেকে রুশদের সঙ্গে সন্ধির প্রস্তাব নিষ্কল হয়। শেষ নিলতার খবর আসে পরদিন, ১ মে, দুপুরের দিকে।
এবং পূর্বেই বলেছি, গ্যোবেল স্থির করেন যে তিনি সপরিবার আত্মহত্যা করবেন। এখন সে সময় এসেছে। তিনি সকলের সঙ্গ ত্যাগ করে সপরিবার আপন বুঙ্কারে চলে গেলেন। কোনও কোনও বন্ধু সেখানে তার কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে নিলেন।
লিঙে বলেন– ট্রেভার রোপার এ-বাবদে স্বল্পভাষী– গ্যোবেলস্ হিটলারের সার্জন ডাক্তার সুমফেগারকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ভিতরে ঢুকতেই গ্যোবেলস্ দম্পতি বেরিয়ে এলেন। ভিতরে কী হল কেউ সঠিক জানে না।
কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার সিঁড়ির কাছে বেরিয়ে এসে ফ্রাউ গ্যোবেলুসের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়লেন–অর্থ, হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রাউ গ্যোবেলস্ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।
ভিতরে কী হয়েছিল, কেউ জানে না, জানবেও না। কারণ ডাক্তার ও গ্যোবেল পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। জনশ্রুতি, ডাক্তার যখন ঘরে ঢুকলেন তখন বাচ্চারা কফি খাচ্ছে। তাদের সঙ্গে তার হৃদ্যতা ছিল; তিনি বললেন, কফি খাওয়া শেষ হলেই তোমাদের সবাইকে নানা রঙের লজেফুস দেব। নতুন ধরনের লজেন্স। বাচ্চারা সাত-তাড়াতাড়ি তাদের কফি, কোকো, দুধ শেষ করল। তিনি বিষে-ব্রা লজেন্স দিলেন। নিজে অন্য ধরনের একটা নিলেন। সব্বাইকে একসঙ্গে মুখে পুরতে হবে। ব্যস হয়ে গেল।…অন্যেরা বলেন, ইনজেকশন দেন, এবং সবচেয়ে বড় মেয়েটি নাকি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নেবে না বলে ধস্তাধস্তি করেছিল। এসব জনশ্রুতির মূলে কী ছিল যে পাষণ্ড এরকম হীন কাজ করতে পারে সে হয়তো বুঙ্কারে তার পরিচিতদের ভিন্ন জনকে স্নি কথা বলেছিল। যে এসব করতে পারে তার পক্ষে বলাটা আর এমন কী কঠিন কর্ম? কিংবা হয়তো তার এসিসটেন্ট ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিল এবং জনশ্রুতিগুলোর মধ্যে একটা হয়তো তার।
এবং আরেকটা কথা বুঙ্কারের প্রায় সবাই জানতেন। একাধিক রমণী গ্যোবেলুদের সব কটি সন্তান একসঙ্গে বা ভাগ-বাটোয়ারা করে, ছদ্মনামে বা আপন নামে পালাতে প্রস্তুত ছিলেন। বল্ট বলেছেন, গ্যোবেলস শেষটায় তার আপন প্রোপাগান্ডার ফঁদে বন্দি। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, বার্লিন অজেয়। তার পর শেষ মুহূর্তে যখন বার্লিনের হাজার হাজার অসহায় শিশু রোগে ক্ষুধায় মরছে, তখন তিনি প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী আপন সন্তানদের নিরাপদ স্থলে পাঠান কী করে? আমি বলি, পাঠালে কী হত? দু-চারটা লোক ঠাট্টা ব্যঙ্গ করত। কিন্তু ছ-ছটি নিষ্পাপ শিশুর জীবন বড়, না দুটো হৃদয়হীনের তিনটে মস্করা!
পূর্বেই বলেছি, শিশুগুলোর সবকটারই নাম ছিল হিটলারের আদ্যক্ষর এইচ দিয়ে। তারা তার সঙ্গেই গেল।
বেঁচে গেল শুধু একজন। গ্যোবেলুসের স্ত্রী তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে লগচ্ছেদ (ডিভোর্স) করে গ্যোবেলুকে বিয়ে করেন। সে-পক্ষের একটি সন্তান ছিল। নাম কোয়ান্ট। গ্যোবেল তাকে খুব স্নেহ করতেন। সে তখন বার্লিন থেকে দূরে। গ্যোবে তার জন্য একখানি সুন্দর চিঠি রেখে যান।
অতঃপর গ্যোবেলস তার অ্যাডজুটান্ট শ্যুগেরমানকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এটাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা; সব-কটা জেনারেল ফুরারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের সবকিছু লোপ হয়ে গেল। আমি সপরিবার আত্মহত্যা করব। তুমি আমার দেহ পোড়াবার ভার নিতে পার? শ্যুগেরমান স্বীকৃত হলেন ও পেট্রলের জন্য লোক পাঠালেন কিন্তু অল্প পরিমাণেই পাওয়া গেল। প্রায় সাড়ে আটটার সময় গ্যোবেল তার স্ত্রীসহ বুঙ্কারের করিডর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে চললেন। পথে শ্যুগেরমান ও ড্রাইভারকে পেট্রলসহ দেখতে পেলেন কিন্তু কোনও কথা বললেন না। বাগানে বেরিয়ে তিনি তার অর্ডারলিকে আদেশ দিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনা তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন। অর্ডারলি দুজনার ঘাড়ের উপর দুটি গুলি মারল। গেরমান শব্দ শোনার পর উপরে বাগানে গিয়ে মাটির উপর দুই মৃতদেহ পেলেন। পূর্বাদেশ অনুযায়ী তাদের চার টিন পেট্রল আঠারো গ্যালন– তাদের উপর ঢেলে চলে গেলেন। ওইটুকু পেট্রলে তাদের শরীরের চামড়া আর পোশাক পুড়েছিল মাত্র। মৃতদেহগুলো বিনষ্ট করার বা গোর দেবার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি। রাশানরা পরের দিন সেগুলো বুঙ্কার আক্রমণ করার সময় পায় ও তাদের শনাক্ত করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। গ্যোবেলসের ঝলসে যাওয়া শরীরের ফোটোগ্রাফ কাগজে বেরোয়। ভাঙা গাল চওড়া কপাল–চিনতে আমার পর্যন্ত কোনও অসুবিধা হয়নি।