প্রহরা পুলিশের এক তৃতীয় ব্যক্তি এই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখবার জন্য বুঙ্কারের পর্চে গিয়ে দাঁড়ান কিন্তু মনুষ্যদেহ-বসা পোড়ার দারুণ উৎকট দুর্গন্ধ তাঁকে সেখান থেকে পালাতে বাধ্য করে।
মিনারের ঘুলঘুলি দিয়ে মানুফেক্ট ও কানাও দেখতে পান, কিছুক্ষণ পরে পরে এনএস-এর লোক বুঙ্কার থেকে বেরিয়ে চিতাতে আরও পেট্রল ঢেলে দিচ্ছে। তার পর দুজনাতে নিচে নেমে এসে দেখেন, লাশগুলোর পায়ের দিকটা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে এবং হিটলারের হাঁটুর হাড় দেখা যাচ্ছে। একঘন্টা পরে তারা ফের এসে দেখেন আগুন তখনও জ্বলছে, কিন্তু তেজ কম।
হিটলার আত্মহত্যা করেন অপরাহ সাড়ে তিনটেয় লিঙের হিসাবে তিনটে পঞ্চাশে। খুব সম্ভব বিকেল চারটে থেকে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছটা অবধি ট্রেল ঢালা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্ট্রেল ফুরিয়ে যাবার পরও দেখা যায়, দেহদুটো পুড়ে ছাই হওয়া দূরে থাক, মাসচাম পুড়ে গিয়ে কালো হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হিটলারকে যারা কাছের থেকে দেখেছেন তারা তখনও তাকে চিনতে পারবেন।
শবদাহকারীগণ পড়লেন বিপদে। হিটলার এ পরিস্থিতির সম্ভাবনা মনশ্চক্ষে দেখেননি এবং সে অনুযায়ী কোনও নির্দেশও দিয়ে যাননি। লিঙে তাঁর বিবৃতিতে হক কথা বলেছেন : পেট্রল দিয়ে মানব-দেহ পোড়ানো তো সহজ কর্ম নয়, হিটলার কেরোসিনের ব্যবস্থা করে গেলেন না কেন? লাশ পোড়ানোর অভিজ্ঞতা ভারতের বাইরে কম লোকেরই আছে। এটা যে কত কঠিন কর্ম সেটা ফেসব নাৎসি গ্যাস-চেম্বারের লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে পরে বিরাট বিরাট চুল্লিতে এদের লাশ পোড়ান, তাঁরা ননবের্গের মোকদ্দমায় জবানবন্দির সময় এ কথার উল্লেখ করেছেন। এঁদের কর্তা বলেন, হাজারখানেক মানুষ গ্যাস দিয়ে মারতে আমাদের বারো মিনিটেরও বেশি সময় লাগত না, কিন্তু সেগুলো পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা ছিল অতিশয় কঠিন ব্যাপার। আমাদের চুল্লিগুলো দিনের পর দিন চব্বিশ ঘণ্টা চালু রেখেও এদের নিশ্চিহ্ন করতে পারতুম না। বিস্তর হাড় চুল্লির তলায় পড়ে থাকত। অন্য এক সাক্ষী বলেন, সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ছিল চুল্লির ধুয়ো। মানুষের পুড়ে-যাওয়া ছাই চিমনি দিয়ে বেরিয়ে বাতাসে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের নাকে-কানে পোশাক-আশাকে সর্বত্র ঢুকে পড়ত। পাশের এবং দূরের গায়ের লোকগুলো পর্যন্ত বুঝে যায় যে আমরা কোন ব্যবসাতে লিপ্ত আছি।
হিটলারের অনুচরবর্গ ভাবলেন, তার প্রধান বাসনা ছিল তার দেহ যেন শক্তহস্তে বর্বর তামাশার বস্তু না হয়; অতএব তাকে যদি খুব গোপনে গোর দেওয়া হয়, তবে ইহুদি ও রুশরা ভার স্বল্পদ দেহ খুঁজে পাবে না। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার পর পুলিশকর্তা রাটেনহুবার গার্ডদের বুঙ্কারে ঢুকে সেখানকার সার্জেন্টকে বলল, হিটলার দম্পতির লাল গোর দেবার জন্য তিনজন বিশ্বস্ত লোন্দ্রে প্রয়োজন। তাদের নিয়ে যেন তিনি আসেন। এঁদের শপথ করানো হল, তারা সবকিছু গোপন রাখবেন। নইলে তাদের গুলি করে মারা হবে।
এদের একজনের নাম মেঙে হাউজ ও অন্যজন গ্ল্যান্সার। দ্বিতীয়জন বার্লিনের রাস্তায় যুদ্ধে মারা যান, এবং প্রথমজন রুশহস্তে বন্দি হয়ে রুশদেশে দশ বছর কাটিয়ে পশ্চিম জর্মনিতে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, হিটলারের শরীর সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া দূরে থাক, তাঁকে তখনও চেনা যাচ্ছিল।
বাগানে চিতার কাছে বোমা পড়ে একটা গর্ত হয়েছিল। মেডে হাউজ ও গ্লান্সার সেটাকে একটা ডবল গোরের সাইজে তিন ফুট গভীর করে খুঁড়লেন। তলায় তক্তা পেতে তার উপর লাশ দুটি রেখে উপরে মাটি চাপা দেয়া হল।
লিঙে ও রাটেনহুবার রুশদেশে দশ বত্সর বন্দিদশায় কাটিয়ে ফিরে এসে বলেন, তারা ঠিক গোরের সম্মুখে উপস্থিত ছিলেন না বটে তবে বাগানের একটা বোমাতে বানানো গর্তে যে উভয়ের কবর দেওয়া হয় সেটা সত্য। রাটেনবার তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বলেন, শেষ মিলিটারি সম্মান দেবার জন্য তার কাছে একখানা স্বস্তিক (হাকেয়ে— হুট ক্রস) পতাকা চাওয়া হয়, কিন্তু তিনি জোগাড় করতে পারেননি।
মধ্যরাত্রে প্রহরী মানসূফেল্ট প্রহরায় ফিরে এসে আবার মিনারে চড়ল। রাশান বোমা তখনও চতুর্দিকে পড়ছিল ও বিমানবাহিনী আকাশে হাউই ফাটাচ্ছিল। তারই আলোকে সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, লাশদুটো নেই, এবং বোমাতে খোঁড়া এবড়ো-খেবড়ো গর্তটা পরিপাটি লম্বমান চতুষ্কোণ গোরের আকারে নির্মিত হয়েছে। তার মনে কোনও সন্দেহ রইল না, এটা মানুষের হাতের দক্ষ কাজ; আকাশ বা কামান থেকে বোমা পড়ার ফলে এরকম সুবিন্যস্ত নমুনা তৈরি হতে পারে না।
ওদিকে তার সহকর্মী কারও রাষ্ট্রভবনের কাছে সঙ্গীদের নিয়ে প্রহরার রোদে বেরিয়েছিল। এদের একজন তাকে বলল, ভাবতে দুঃখ হয়, অফিসারদের একজনও ফুরারের দেহ কোথায় রইল না-রইল সে-সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন। আমি তার দেহ কোথায় আছে জানি বলে গর্ব অনুভব করি। (লোকটি হয় মেঙেরস হাউজন, নয় গ্লানৎসার)।
কিন্তু যে-ই হোক, লোকটির বাক্যটি ন’সিকে খাঁটি। হিটলারের মৃত্যুর পর থেকে বাকি সব ব্যবস্থা অত্যন্ত অবহেলা ও দরদহীনভাবে করা হয়। এমনিতে জর্মনরা অত্যন্ত পাকা কাজ করতে অভ্যস্ত। তা হলে এমনটা হল কেন? খুব সম্ভবত লোকে যে বলে হিটলার তার সাঙ্গোপালকে (এমনকি বহু বিদেশিকেও) মন্ত্রমুগ্ধ, প্রায় মেয়েরাইজ করে রাখতেন সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। সেই ভানুমতীর ভোজবাজির সঙ্গে সঙ্গে যখন ম্যাজিসিয়ান হিটলার-ভানুমতীও অন্তর্ধান করলেন তখন তারা হঠাৎ সচেতন হল, তাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে। অন্ধ হোক সত্য বিশ্বাস হোক, এতদিন শুরুর পর তারা তাদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন ঈ ফর হিমসেল অ্যান্ড ডেভিল টেক দি হাইভমোস্ট– চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা, আর শয়তান নিক যেটা সক্কলের পিছনে, যেটা অগা কাঁচা। বরমান অবশ্য তখন নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, কিন্তু বুঙ্কারের অন্যতম অধিবাসী– সে বেচারি লাটবেলাট কিছুই না, এমনকি সামান্য আগডোম বাঘডোমের ডোম সেপাইও নয়, সে নগণ্য দরজি, ইউনিফর্ম বানায়, বিপুক করে– সে বলে, নেতৃত্ব কখনও এক কানাকড়িও ছিল না, লোকগুলো হেথাহোথা ছুটোছুটি করছিল মুকাটা মুরগির মতো। কিন্তু সেটা তার পরের অধ্যায়ের কাহিনী- সেটা আমি লিখতে যাচ্ছিনে।