এ ঘটনার উল্লেখ আর কেউ করেননি, কারণ লিঙে ভিন্ন আর সবাই ওপারে। ইতোমধ্যে হিটলারের অন্তরতম অন্তরঙ্গ জনা পনেরো বুঙ্কারের করিডরে দাঁড়িয়ে আছেন। হিটলার ও ফ্রাই হিটলার (এফা) তাদের সঙ্গে নীরবে একে একে করমর্দন করলেন। এই শেষ বিদায়। ফ্রাউ গ্যোবে উপস্থিত ছিলেন না। সন্তান কটির আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন।
বুঙ্কারে সৈন্যসামন্ত এবং তজ্জনিত রূঢ় কঠোর বাতাবরণের ভিতর এসব সুন্দর মধুর বাচ্চাদের দেখাত যেন অন্য কোনও জগতের কোনও বেহেশতের ফিরিশতা দেবদূতের মতো। তারা এর থেকে ওঘরে ছুটোছুটি করত। এক বুঙ্কার থেকে অন্য বুঙ্কারে যেতে হলে যেখানে দেশের প্রধান সেনাপতি কাইটেলকেও পাস দেখাতে হত সেখানেও তাদের অবাধ গতি। যে কদিন পাইলট নারী হানা রাইটশ বুঙ্কারে ছিলেন তারা তার কাছ থেকে কোরাস্ গান শিখেছে। তাদের কী ভয় ওই তো কাকা অ্যাডলফ রয়েছেন। তিনি ঈশ্বরের মতো (ঈশ্বর জাতীয় কুসংস্কার গ্যোবেলস্ দম্পতি হয়তো বাচ্চাদের জন্য ব্যান করে দিয়েছিলেন? সর্বশক্তিমান এই তো তারা জনের প্রথম দিন থেকে জানে। কাকা হিটলারের অনুকরণে তাদের প্রত্যেকের নাম, এইচ অক্ষর দিয়ে আরম্ভ।
শেষ বিদায় নেবার পর একমাত্র তারাই করিডরে রইলেন যারা হিটলারের শেষকৃত্য সমাধা করবেন, অন্যদের বিদায় দেওয়া হল।
হিটলার ও এফা তার পর তাদের খাস কামরাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই,-লিঙে তার বৃতিতে বলেছেন তিনি হঠাৎ কী এক অজানা ভয়ে করিডর দিয়ে ছুটে পালালেন। অল্পক্ষণের ভিতরই কিন্তু তার মাথা ঠাণ্ডা হল। তিনি ধীর পদক্ষেপে ফিরে এলেন।
এর পরের ঘটনা দিয়ে, আমরা এ-প্রবন্ধ আরম্ভ করেছি। মাত্র একটি গুলি ছোঁড়ার শব্দ শোনা গেল, এবং লিঙে বলছেন পোড়া বারুদের কটু গন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে ভেসে এল।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে লিঙে, গ্যুনশে, বরমান, গ্যোবেলস ইত্যাদি ঘরে ঢুকলেন এবং যা দেখতে পেলেন তা পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে।
মৃতদেহ দুটি পোড়াবার জন্য দশ লিটার পেট্রল অনছে সেদিন সকালেই হিটলার তার অ্যাডজুটান্ট গনশেকে আদেশ দিয়েছিলেন। গুনশে হিটলারের ড্রাইভার কেস্পকাকে সে আদেশ জানালে তিনি বলেন, অতখানি পেট্রল জোগাড় করা সম্ভব হবে না (রুমানিয়া রাশান হাতে চলে যাওয়ার পর বার্লিন আর কোনও পেট্রল পায়নি)। অবশেষে পেতে হবেই হবে আদেশ এলে কেম্পকা অতি কষ্টে ১৮০ লিটার পেট্রল টিনে করে বুঙ্কারের বাইরে বাগানে পাঠিয়েছিলেন। শেষ রেস্ত খতম না হওয়া পর্যন্ত হিটলার যে জুয়োখলা বন্ধ করেননি, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
সকাল থেকেই অন্যান্য বুঙ্কার থেকে হিটলার-বুঙ্কারে আসার সব-কটা পথ তালা মেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল যাতে করে অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং প্রয়োজনীয় জন ভিন্ন অন্য কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু টের না পায়।
হিটলারের আপন সৈন্যবাহিনী এসএস, সৈন্য ও লিঙে হিটলারের দেহ কষলে জড়িয়ে নিলেন- রক্তমাখা মাখা-মুখ ঢাকবার জন্য। পরিচিত কালো পাতলুন পরা পা দুখানা দেখে করিডরে আর সবাই অনায়াসে ইনি যে হিটলার সেকথা বুঝতে পারলেন। চার দফে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে এরা পঞ্চাশ ফুট উপরে খোলা বাগানে বেরুলেন। ইতোমধ্যে বরমান এফার দেই তুলে নিলেন। তিনি বিষ খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে তার দেহে কোনও রক্তের দাগ ছিল না, এবং দেহটিকে ঢাকবার প্রয়োজন হয়নি। বাগানে এনে তার দেহ হিটলারের দেহের পাশে শোয়ানো হল।
কিন্তু ইতোমধ্যে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। মাটির উপরে বুঙ্কারে যে প্রহরা মিনার ছিল সেখান থেকে প্রহরারত মানুফে নিচে সন্দেহজনক দ্রুত চলাফেরা; দরজা খোলাবন্ধ কার শব্দ শুনতে পেল। প্রহরীর কর্তব্য অনুযায়ী অনুসন্ধান করতে নিচে এসে বুঙ্কারের সামনে সে খেল ধাক্কা শবযাত্রার সঙ্গে। এফাকে সে পরিষ্কার চিনতে পারল এবং কম্বলে ঢাকা শরীর থেকে কালো পাতলুন পরা দুখানা পা ঝুলছে দেখতে পেল। সঙ্গে বরমান, জেনারেল কুড (পূর্বের সেই পাড় মাভাল), দানব সাইজের অ্যাডজুটান্ট গুশে, ভ্যালে লিঙে। গুশে হুঙ্কার দিয়ে মাসূল্টেকে সরে যেতে বলল। অদর্শনীয় চিত্তাকর্ষক ব্যাপার দেখা হয়ে গেল মাফেক্টের।
বরমান সম্প্রদায় সব আটঘাট বেঁধে ভেবেছিলেন সাবধানের মার নেই।
সপ্রমাণ হল মারেরও সাবধান নেই।
অনুষ্ঠান আবার চলল।
বুঙ্কারের দরজার উপর পর্চ ছিল। দরজা থেকে কয়েক হাত দূরে দুটি লাশ মাটিতে বইয়ে তার উপর পেট্রল ঢালা হল। এমন সময় রাশান কামানের বোমা এসে পড়তে লাগল বলে শবযাত্রীরা পর্চের তলায় আশ্রয় নিলেন। ট্রেভর রোপারের মতে গুশে একখানা ন্যাকড়াতে পেট্রল ভিজিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে সেটা লাশদের উপর ছুঁড়ে ফেললেন। লিঙে বললেন, তিনি খবরে কাগজে আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারেন। সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠে লাশ দুটো ঢেকে ফেলল। পর্চে দাঁড়িয়ে শবযাত্রী দল হিটলারকে শেষ মিলিটারি সেলুট দিলেন। তার পর তারা বুঙ্কারের ভিতরে ফিরে গেলেন।
কারনাও নামক আরেকজন সাধারণ প্রহরীরও এসব গোপন অনুষ্ঠান দেখবার কথা নয়। বুঙ্কারের ভেতরকার দরজা তালাবন্ধ দেখে সে-ও বাগানের দিক দিয়ে ঘুরে আসার চেষ্টা করে মোড় নিতেই আশ্চর্য হল। হঠাৎ সামনে দেখে দুটি মৃতদেহ পাশাপাশি শুয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো দপ করে জ্বলে উঠল–বুঙ্কার মিনারের পর্চে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বলে সে দেখতে পায়নি, ওখান থেকেই জ্বলন্ত ন্যাকড়া, কাগজ ছুঁড়ে লাশে আগুন ধরানো হয়েছে। খানিক পর আগুন একটু কমে যেতে সে পরিষ্কার চিনতে পারল ভগ্ন-মুণ্ড হিটলারের দেহ। প্রহরী কানাও কিন্তু সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। পরে সে বলে, বীভৎসতম দৃশ্য। গুশের মতো বিরাট-দেহ দানব তাবৎ জৰ্মনিতেই কম ছিল। অল্পেতে বিচলিত হবার পাত্র নয়। সে পর্যন্ত বলে, হিটলারের দেহ-দাহ-দর্শন আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।