২৯ তারিখ অপরাহ্নে হিটলারের আদেশে তার প্যারা অ্যালসেশিয়ান কুকুর ব্লন্ডিকে গুলি করে মারা হল। সেদিনই তিনি তার দুই মহিলা সেক্রেটারিকে চরম সঙ্কটে ব্যবহারের জন্য বিষের ক্যাপসুল দিতে দিতে দুঃখ করে বললেন যে, শেষ বিদায়কালে তিনি এর চাইতে ভালো কোনও উপহার দিতে পারলেন না।
সেই রাত্রে হিটলার ভিন্ন ভিন্ন বুঙ্কারবাসীদের খবর পাঠালেন, তিনি মহিলাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে চান, তারা যেন অপেক্ষা করেন। রাত আড়াইটার সময় (৩০ এপ্রিল আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। প্রায় কুড়িজন অফিসার ও মহিলা সারি বেঁধে করিডরে দাঁড়ালেন। বরমানসহ হিটলার বেরিয়ে এসে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন এবং মহিলাদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। হিটলারের চোখের উপর যেন ক্ষীণ বাষ্পের হালকা পরশ লেগে আছে। এ বিষয় এবং তার মৃত্যু, শবদাহ ইত্যাদি অনেকেই সবিস্তর লিখেছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হিটলারের ড্রাইভার কেম্পকার আমি হিটলারকে পুড়িয়েছিলুম এবং লিঙের কাহিনী। হিটলারের অন্যতম মহিলা সেক্রেটারি ছদ্মনামে হিটলার প্ৰিভাট অর্থাৎ হিটলারের প্রাইভেট জীবন নিয়ে বই লেখেন। সর্বশেষে হিটলারের নরদানব অ্যাডজুটান্ট গুশের বিবৃতি-রুশ কারাগারে দশ বছর কাটানোর পর জর্মনি ফিরে এসে তিনি বিবৃতি দেন। কিন্তু ট্রেভার রোপার সকলের জবানবন্দি ও বিবৃতি যাচাই করে লিখেছেন বলে তাঁকে অনুসরণ করাই প্রশস্ত। এস্থলে বলে রাখা ভালো হিটলার সপ্তাহখানেক পূর্বে তার চারজন মহিলা সেক্রেটারিকে বুঙ্কার ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যাবার প্রস্তাব করেন। দুজন চলে যান, দুজন থাকেন। নিরামিষাশী হিটলারের জন্য রান্না করতেন ফ্রলাইন মানৃৎসিয়ালি। তিনিও থেকে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। লিঙেকেও যাওয়া না-যাওয়া তার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি যাননি। ফলে রাশাতে দশ বৎসর কারাভোগ করতে হয়েছিল।
অবধারিত আশু বিপদের সামনে মানুষ সবসময় ভেঙে পড়ে না। জাপানিরা যখন সিঙ্গাপুর দখল করে তখন সবকিছু জেনেশুনেই সিঙ্গাপুর-বাসিন্দারা বিশেষ করে ইংরেজগুষ্টি নৃত্য-মদে মত্ত ছিলেন। এস্থলেও তাই হল। হিটলারের বিদায় নেওয়ার পরই সবাই বুঝে গেল, এই শেষ, আর আশা-নিরাশার কিছু নেই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বুঙ্কারে হিটলারেরটা প্রথম) তখন আরম্ভ হল জালা জালা অত্যুকৃষ্ট মদ্যপান ও গ্রামোফোনযোগে নৃত্য। হেসে নাও দু দিন বই তো নয়- এস্থলে দু দিন শব্দার্থে। ঠিক দুদিন বাদেই রুশরা বুঙ্কার দখল করে।
৩০ এপ্রিল শেষ দিন
সকালবেলা জেনারেলরা বার্লিনের ভিন্ন ভিন্ন অংশের খবর নিয়ে মন্ত্রণাসভায় এলেন। অবস্থা আগের চেয়ে সামান্য একটু ভালো, কিন্তু হরেদরে সেই পুরনো কাহিনীজনরা যদি অসীম বিক্রমে কোনও এক অংশে একটুখানি এগোয় তবে কশা আর পাঁচটা দুর্বল জায়গায় তারও বেশি এগিয়ে আসে।
হিটলার আগের রাত্রে যে শেষ টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তার উত্তর আসেনি, আর বরমান হিটলারের অনুমতিতে বিনানুমতিতে গণ্ডায় গণ্ডায় যেসব টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তারও কোনও উত্তর নেই।
দুপুরবেলার মন্ত্রণাসভা হিটলারের জীবনের শেষ সভা। এবং সে-সভায় যে খবর সব এল সে-রকম দুঃসংবাদ তিনি জীবনে আর কখনও শোনেননি (এবং শুনতেও হবে না)। রাষ্ট্রভবন থেকে উত্তরে বেরোবার পথে খোল। তার ভাইডেনডামার ব্রিজের কাছে রুশরা এসে গেছে (এই পোলের উপর দিয়েই বমান এবং কয়েকজন পরের দিন বার্লিন থেকে বেরুনোর চেষ্টা করেছিলেন। অর্থাৎ উত্তরের পথও বন্ধ হল। এবং রাষ্ট্রভবনের এক কোণ যে ফস ব্রিটে এসে ঠেকেছে তার অন্য প্রান্তে টানেলের কিছুটা রুশরা দখল করে ফেলেছে। নির্লিপ্ত নিরাসক্ত চিত্তে হিটলার সঞ্জয়-বার্তা শুনে গেলেন।
দুটোর সময় হিটলার লাঞ্চ খেতে বসলেন। এফা আসেননি।
তিনি যে মানসিক চঞ্চলতা ও উত্তেজনায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন সেকথা লিঙে বলেছেন। ট্রেভার রোপার ঐতিহাসিক। মানুষের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ নিয়ে তার কারবার কম– বিশেষ করে এফা যখন ইতিহাসে কোনও অংশ নেননি, তখন তিনি যে তাকে কিঞ্চিৎ অবহেলা করবেন সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু লিঙে ভ্যালে। তিনি তাঁর বিবৃতিতে যে এফার জন্য একটু বেশি স্থান দিয়েছেন সেটা কিছু বিস্ময়জনক নয়। লিঙে বলেছেন, ওই শেষের দিনেও তিনি লিঙেকে অনুরোধ করেন, হিটলারকে বুঙ্কার ত্যাগ করার জন্য চেষ্টা দিতে। এস্থলে অন্য আরেকটি ব্যাপারে ট্রেলার রোপারের সঙ্গে লিঙের কাহিনী মেলে না। ট্রেভার রোপারের মতে গ্যোবেল আগাগোড়া হিটলারকে বার্লিন ত্যাগ না করতেই উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু লিঙের বিবরণী থেকে জানা যায়, গোড়ার দিকে না হোক, অন্তত শেষের দিকে তিনি পর্যন্ত লিঙেকে এফারই মতো অনুরোধ জানান, লিঙে যেন হিটলারকে বার্লিন ত্যাগ করার কথা বোঝান। লিঙে নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তিনি ফুরারের মন্ত্রী ও নিত্যালাপী হয়েও যে কর্ম সমাধান করতে পারেননি, সামান্য লিঙে সেটা করবেন কী প্রকারে?
লাঞ্চের পর হিটলার যখন বিশ্রাম করছেন তখন ফ্রাউ (মিসেস) গ্যোবেল লিঙের হাতে একখানা চিরকুট দেন হিটলারের জন্য। শেষবারের মতো একবার দেখা করে যেতে। হিটলার প্রথমটায় কুঞ্চিত করে পরে সেদিক পানে চললেন। সিঁড়িতে গ্যোবেলসের সঙ্গে দেখা। তিনি হিটলারকে মত পরিবর্তন করতে বললেন। হিটলার অনিচ্ছা জানিয়ে আন বুঙ্কারে ফিরে এলেন।