পার্টি চালু রেখে তিনি পাশের ঘরে তার স্টেনট-সেক্রেটারি ফ্রাউ যুঙেকে নিয়ে তার দু-খানা উইল মুখে মুখে বলে যেতে লাগলেন। প্রথম উইলখানা রাজনৈতিক, দ্বিতীয়বানা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে। পাঠক হিটলার সম্বন্ধে যে-কোনও বইয়ে এ দু-খানার কপি পাবেন। আমি সংক্ষেপে সারি। সর্বপ্রথমেই তিনি আরম্ভ করেছেন এই বলে যে, একথা মিথ্যে যে আমি বা জর্মনির আর কেউ এ যুদ্ধ চেয়েছিল। এটা ইহুদি এবং যারা তাদের জন্য কাজ করে তাদের কীর্তি…এখন আমার সৈন্যদল আর নেই বলে রাষ্ট্রপতি ভবন আক্রান্ত হলে আমি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করব। আমি শক্রর হাতে ধরা দেব না–ইহুদিরা যাতে করে আমাকে নিয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত জনতার জন্য একটা নয়া তামাশা সৃষ্টি না করতে পারে। তার পর তিনি গ্যোরি ও হিমলারকে নাৎসি পার্টি থেকে ও সর্ব আসন থেকে বিচ্যুত করে বললেন, এঁরা যে শক্তিলোভে শক্রর সঙ্গে গোপন-সন্ধি-প্রস্তাব করে শুধু আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাই নয়, জর্মনি ও তার নাগরিকদের মুখে অমোচনীয় কলঙ্ককালিমা মাখিয়েছেন। হিটলারের মূলমন্ত্র ছিল যুদ্ধের সাধন কিংবা জীবনপাতন–সন্ধির ইচ্ছা প্রকাশ করাই বেইজ্জতির চূড়ান্ত। সর্বশেষে তিনি জর্মনদের কঠোরতম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের রক্তে যেন সংমিশ্রণ না হয় তার জন্যে, এবং বিশ্বে বিষসঞ্চারণকারী আন্তর্জাতিক ইহুদিদের নির্দয়ভাবে প্রতিরোধ করার জন্য দিব্য দিলেন।…এই উইলেই তিনি এডমিরাল ড্যোনিৎসকে দেশের নেতৃত্ব দিলেন, এবং তার জন্যে মন্ত্রিসভা নির্বাচন করে গেলেন।(১৩)
তার ব্যক্তিগত হ্রস্ব উইলে তিনি একাকে বিবাহ করার পটভূমি ও কারণ দর্শালেন। তার পর বললেন, তিনি স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করছেন। তার সমস্ত সম্পত্তি তিনি নাৎসি পার্টিকে দান করলেন, পার্টির অস্তিত্ব লোপ পেলে জর্মন রাষ্ট্রকে, এবং সে-ও যদি লোপ পায় তা হলে সে বিষয়ে তার আর কোনও নির্দেশ নেই। তার বিরাট চিত্রসঞ্চয় তিনি তার জন্মভূমির লিনৎস শহরের যাদুঘর নির্মাণের জন্য দিলেন। দরকার হলে তার এবং তার স্ত্রীর আত্মজন, তাঁর সহকর্মী সেক্রেটারি ইত্যাদি যেন মধ্যবিত্ত গৃহস্থের মতো জীবনযাত্রা করতে পারেন, তার আর্থিক ব্যবস্থাও তিনি উইলে রাখলেন।… উইল লেখা শেষ হলে ভোর চারটায় তিনি শুতে গেলেন। হায়রে বাসরশয্যা।
গ্যোবেলসও তাঁর উইল লিখলেন। তার প্রধান বক্তব্য : ফুরার আমাকে আদেশ দিয়েছেন, নতুন মন্ত্রিসভায় অংশ নিতে, কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার (এবং ইচ্ছে করলে তিনি শেষবারের মতোও লিখতে পারতেন; কেন করলেন না, বোঝা ভার) আমি ফুরারের আদেশ সরাসরি লঙ্ঘন করছি। আমি, আমার স্ত্রী ও পুত্রকন্যাগণসহ ফুরারের পার্শ্বেই জীবন শেষ করব। এর পর আছে সর্বব্যাপী বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি ইত্যাদির কথা।
সেই দিন ২৯ এপ্রিল। দুপুরের দিকে চারজন বিশ্বস্ত লোক মারফত তিনখানা উইল তিন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করা হল। যে করেই হোক তারা যেন কুশব্যুহ ভেদ করে, কিংবা ব্যুহে কোনও ছিদ্র থাকলে তাই দিয়ে ড্যোনিসের কাছে পৌঁছয়, নইলে ব্রিটিশ বা মার্কিন অধিকৃত অঞ্চলে।
দুপুরবেলা মন্ত্রণাসভা বসল। সেখানে প্রধান খবর, রাশানরা এগিয়ে এসেছে এবং ভেংকের কোনওই খবর নেই। তিনজন অফিসার- এদের মধ্যে ছিলেন আমাদের পূৰ্বোল্লিখিত বই– বললেন, তারা ভেংকের সন্ধানে ও তাকে বার্লিন পানে ধাওয়া করবার জন্য ফুরারের আদেশ পৌঁছে দিতে প্রস্তুত আছেন। হিটলার অনুমতি দিলেন। রাত্রের মন্ত্রণাসভার পর আরেকজন চলে যাবার অনুমতি পেলেন।
রাত্রের মন্ত্রণাসভায় বার্লিনের কমান্ডান্ট জানালেন, রাশানরা চতুর্দিক থেকেই শহরের ভিতরে এগিয়ে এসেছে। পয়লা মে তারা বুঙ্কার (এবং রাষ্ট্রভবনে পৌঁছে যাবে। বার্লিনের ভিতর যেসব জর্মন সৈন্যদল আটকা পড়েছে তারা এইবেলা যদি রুশব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে না যায়, তবে আর কখনও পারবে না। হিটলার বললেন, দু-একজনের পক্ষে কোনওগতিকে বেরোনো সম্ভব হলেও হতে পারে কিন্তু এইসব রণক্লান্ত ভাঙাচোরা হাতিয়ারে সজ্জিত তারও আবার গুলি-বারুদের অভাব সৈন্যরা দল বেঁধে, তা সে যতই ঘোট দল থোক না কেন, কখনওই বেরুতে পারবে না। ব্যস, হয়ে গেল; হিটলারের অভিমতই সর্বশেষ অভিমত। সৈন্যদের কপালে নিরর্থক মৃত্যুর লাঞ্ছন অঙ্কিত হয়ে গেল।
এই সময়ে হিটলার তার সর্বশেষ টেলিগ্রাম পাঠান জেনারেল ইয়োডকে। আশ্চর্যের বিষয়, ট্রেভার রোপারের মতো অতুলনীয় ঐতিহাসিক এই শেষ টেলিগ্রামের উল্লেখ করেননি। বলট তো তার আগেই বুঙ্কার ত্যাগ করেছেন তার কথা ওঠে না। হিটলারের কোনও প্রামাণিক জীবনীতেও আমি এর উল্লেখ পাইনি। শুধু আসমা ও অন্য কোনও নৌ-সেনাপতি এর উল্লেখ করেছেন; আমান্ তাঁর ইতিহাসে টেলিগ্রামখানার ফটোও দিয়েছেন। তাতে হিটলারের সেই আর্তকণ্ঠে প্রশ্ন, ভেংক কোথায়, নবম বাহিনীর পুরোভাগ কোন কোন স্থলে পৌঁছেছে, ইত্যাদি; আমি এই মুহূর্তেই উত্তর চাই।
সেদিনই খবর পৌঁছল, হিটলার-সখা ডিকটেটর মুসসোলিনিকে মিলানের বিদ্রোহী দল তাকে তার উপপত্নীর সঙ্গে ইতালি ছেড়ে সুইটজারল্যান্ডে পলায়নের সময় ধরে দুজনকে খতম করে শহরের মাঝখানের বাজারে পায়ে পায়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে যাতে করে উত্তেজিত প্রতিহিংসোন্মত্ত জনগণ দুজনাকে পেটাতে ও পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে পারে। এ সংবাদ হিটলারের মনে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল জানা যায়নি। তবে বহু ডিকটেটরদের শেষ পরিণতি হিটলারের কাছে কোনও নতুন খবর নয়। তাই উইল লেখার সময় ও তার পূর্বেও হিটলার আদেশ দিয়েছিলেন তার ও এফার দেহ যেন পুড়িয়ে এমনভাবে ভস্ম করে দেওয়া হয় যে ইহুদিরা পাগলা জনতাকে তামাশা দেখাবার জন্য কোনও কিছু না পায়। বুঙ্কারের একাধিক বাসিন্দা হুবহু একই ভাষায় এই মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছেন।