হিমলারের বিশ্বাসঘাতকতার পর হিটলারের সর্বশেষ কর্ম সম্বন্ধে মনস্থির করতে আর কোনও প্রতিবন্ধকতা রইল না। প্রথমেই হিমলারের বিশ্বাসী নায়েব, প্রতিতু, লিয়েজে অফিসার ফেগেলাইনকে বন্দিশালা থেকে বের করে নিয়ে এসে সওয়াল করা হল। এইসব বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে তিনি কতখানি একিবহাল ছিলেন ফেগেলাইন কী উত্তর দিয়েছিলেন তা আর জানবার উপায় নেই। প্রশ্নকর্তারা মৃত নয়, নিরুদ্দেশ। হিটলারের যুক্তি, ফেগেলাইন যদি না জানবে তবে পালাবার চেষ্টা করল কেন? বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কী? হুকুম দিলেন, বুঙ্কারের বাইরের বাগানে তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে। বল্টু তার বইয়ে বলেছেন, এফা তার ভগ্নিপতিকে বাঁচাবার কোনও চেষ্টা করেছিলেন কি না আমরা তার কোনও খবর পেলুম না, হয়তো স্বামীর ওপর তার কোনও প্রভাবই ছিল না, কিংবা হয়তো তিনি তার স্বামীর মতোই ধর্মান্ধের মতো বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাসঘাতকের প্রাপ্য মৃত্যুদণ্ড– তা সে যে-ই হোক। আমাদের মনে হয় দুটোই। ওই সময় শ্রীমতী হানা রাইটশ বুঙ্কারে ছিলেন। ইনি বিশ্বের অন্যতম নামজাদা পাইলট (পরবর্তীকালে পণ্ডিতজীর সঙ্গে এর হৃদ্যতা হয় এবং তার অতিথি হয়ে কিছুদিন দিল্লিতে ছিলেন)। ইনি বলছেন, এফা নাকি ওই সময় বেদনাভরে এক হাত দিয়ে আরেক হাত মোচড়াতে মোচড়াতে যাকে পেতেন তাকেই বলতেন, হায় বেচারা, বেচারা অ্যাডলফ। সবাই তাকে ত্যাগ করেছে, সবাই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দশ হাজার লোক মরুক ক্ষতি নেই, কিন্তু জর্মনি যেন অ্যাডলফকে না হারায়।
রুশরা বুঙ্কার থেকে আর মাত্র হাজার গজ দূরে।
২৮/২৯ এপ্রিলের রাত। ফেগেলাইনের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হিটলার অন্যান্য কর্তব্যের দিকে মন দিলেন। যে রমণী তাঁকে ১৪/১৫ বৎসর ধরে ভালোবেসেছেন, ভালোবাসার প্রথম দিকে একবার নিরাশ হয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টাতে গুরুতররূপে জখম হন, হিটলার যাকে বিশ্বাস করতেন সবচেয়ে বেশি (হিটলারও বলতেন, তিনি দুজনকে অবিচারে বিশ্বাস করেন। একা ও তার আলসেশিয়ান ব্লন্ডিকে), সঙ্কট ঘনিয়ে এলে তার নিরাপত্তার জন্য হিটলার বার বার চেষ্টা করা সত্ত্বেও যিনি তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে রাজি হননি, এবং যিনি দৃঢ়কণ্ঠে একাধিকজনকে একাধিকবার বলেছেন, অ্যাড আর আমার জীবনমরণ একসূত্রে গাঁথা, সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে যাকে হিটলার অল্প লোকের সামনেই বেরুতে দিতেন, কোথাও যেতে হলে ভিন্ন ভিন্ন মোটরে যেতেন, সভাস্থলে এফা দর্শকদের সঙ্গে বসে হিটলারের বক্তৃতা শুনতেন– সেই একা এত বৎসর পর তার ন্যায্য প্রাপ্য অধিকার এবং আসন পেলেন। সে রাত্রে হিটলার তাঁকে বিয়ে করলেন।
কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা ডিকটেটরদের প্রিয়া, রক্ষিতা, উপপত্নী, পত্নীরা যেরকম রোমান্টিকভাবে তাদের বল্লভদের জীবন প্রভাবান্বিত করেন, পর্দার সামনে কিংবা আড়ালে বহুলোকের জীবনমরণ নিয়ে খেলা করেন চক্রান্ত, বিষপ্রয়োগ অনেক কিছু করে থাকেন, এফার সেদিকে কোনওই আকর্ষণ ছিল না। কর্মব্যস্ত হিটলার তার সঙ্গে দেখা করার সময় পেতেন কমই। বিশেষ করে যুদ্ধের পাঁচ বৎসর তিনি ভিন্ন আর্মি হেড কোয়ার্টার্সের সন্নিধানে থাকতে বাধ্য হতেন বলে প্রোষিতভর্তৃকা এফা দূর আপসের উপর হিটলারের নির্জন নিরানন্দ বের্গহ বনে একা একা দিনের পর দিন তার জন্যে প্রতীক্ষা করতেন। চাকর-বাকররা বলত এ যেন সোনার খাঁচার বদ্ধ পাখি। তার পর হঠাৎ একদিন বল্পত এসে উপস্থিত হতেন অতিশয় অন্তরঙ্গ সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। বাড়ি গমগম করে উঠত। ডিনার, তার পর ফিল, তার পর সঙ্গীত, রাত দুটোয় শেষ পার্টি- হিটলার টিটোটেলার, খেতেন হালকা চা, কাপের পর কাপ, অন্য সবাই শ্যাম্পেন। হিটলার ঘুম থেকে উঠতেন দেরিতে। খেয়ে জিরিয়ে এফা, ব্লন্ডি, অনুচরদের নিয়ে নির্জন পথে বেড়াতে বেরুতেন। পথের শেষপ্রান্তে একটি বিশ্রামাগার। সেখানে চা, কেক, ক্রিম-বান্ খাওয়া হত। হিটলার প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তেন। সবাই ফিফিস্ করে কথা বলত, প্রভুর নিদ্রা ভঙ্গ হলে সবাই বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু বৃহত্তর সমাজে তার স্থান ছিল না। হিটলারের মৃত্যুর পূর্বে ১০ লক্ষের ভিতর একজনও জানত না, হিটলারের কোনও বান্ধবী আছেন।(১১)
এই দুর্দিনে বিয়ের রেজেস্ট্রি অফিসার জোগাড় করা সহজ হয়নি। শেষটায় একজন এলেন যাকে বুঙ্কারের কেউই চেনে না। গ্যোবেলস্ এঁকে জোগাড় করে এনেছেন; লিঙের মতে ইনিই নাকি একদা গ্যোবেসের বিয়ে সম্পন্ন করেন। এমার্জেন্সি বা বিনোটিসের বিয়ে বলে বড়ম্বর আর বাহ্যাড়ম্বর বাদ দেওয়া হল। দুই পক্ষে মৌখিক সাধারণত হিটলার জর্মনিতে সার্টিফিকেট দরকার হত–শপথ দিলেন, উভয়েই অবিমিশ্র আর্যরক্ত ধরেন, ও তাদের বংশগত কোনও ব্যাধি নেই। তার পর উভয়ে রেজিস্ট্রিতে সই করলেন। কনে নাম সই করার সময় একা লিখে ব্রাউন লেখবার জন্যে বি হরফ লিখে ফেলেছিলেন; তাঁকে ঠেকানো হল, তিনি বি কেটে হিটলার ও ব্রাউন নামে জন্ম (nee) লিখলেন। গ্যোবেল ও বরমান সাক্ষী হলেন।(১২) রাত তখন একটা বেজে গিয়েছে। ২৯ এপ্রিল শুরু হয়েছে।
বিয়ের পর হিটলারের ঘরে পার্টি বসল। শ্যাম্পেন এল। বহু বৎসর পূর্বে গ্যোবে যখন বিয়ে করেন তখন হিটলার সে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। গ্যোবেলুস্ দম্পতি ও হিটলার সেই অবিমিশ্র আনন্দের দিনের সঙ্গে অদ্যকার আনন্দের ওপর করাল ছায়ার তুলনা করে সে সম্বন্ধে মন্তব্য করলেন। জর্মন ভাষায় একটি সংহিটে আছে, চোখের জল নিয়ে আমি নাচছি– এ যেন তাই। হিটলার আবার তাঁর আত্মহত্যার কথা তুললেন। বললেন, তাঁর জীবনাদর্শ (ভেল্টআনশাউউঙ) নাৎসিবাদ খতম হয়ে গেল; এর পুনর্জন্ম আর কখনও হবে না। তার সর্বোত্তম বন্ধুরা তার সঙ্গে প্রবঞ্চনা আর বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। মৃত্যুর ভেতর দিয়েই তিনি এসব থেকে নিষ্কৃতির আরাম পাবেন।