১৪ তারিখে রেণু বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। ঈদের জন্য এই অনুমতি দিয়েছে। বাইরে সকলেই ১৩ তারিখে ঈদ করেছে। ঈদের আনন্দ তো বন্দিদের থাকতে পারে না। তারপর আবার রেণু এক দুঃখের সংবাদ আমাকে জানাল। আমার ফুফাতো ভাই, ক্যান্সার হয়েছিল, মারা গিয়াছে। মাদারীপুরে বাড়ি—ছোট বেলায় আমার ফুফা ও ফুফু মারা যান, আমার আব্বাই ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, ম্যাট্রিক পর্যন্ত আমরা এক সাথেই ছিলাম। সিভিল সাপ্লাই অফিসে সামান্য চাকরি করত। কয়েকটা ছেলেমেয়ে রেখে গিয়াছে, জমিজমা যা ছিল প্রায়ই আড়িয়াল খাঁ নদী গ্রাস করে নিয়েছে। কি করে এদের চলবে? ছেলেমেয়েগুলি ছোট ছোট।
সময় কেটে গেল, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি এসে শুয়ে পড়লাম, আর ভাবলাম এই তো দুনিয়া! রাত কেটে গেল, খাওয়া-দাওয়া ভাল লাগল না। ছোট বেলায় আমি আর আমার ফুফাতো ভাই ৭/৮ বৎসর এক ঘরেই থেকেছি। ওর ডাকনাম ছিল তারা মিয়া।
১৫ তারিখে ৪০ সেলের পাগলা গারদের পাগল ভাইদের জন্য নিজেই মুরগি পাক করে পাঠাইয়া দিলাম। আমি না খেয়ে জমাইয়া ছিলাম। আমার যাওয়ার হুকুম নাই ওদের কাছে—যদিও খুবই কাছে আমি থাকি। জমাদার সাহেবকে ডেকে বললাম, আপনি দাঁড়াইয়া থেকে ওদের মধ্যে ভাগ করে দিবেন। তিনি তাই করলেন। ওরা যে আমার বহুদিনের সাথী, ওদের কি আমি ভুলতে পারি? ভুলতে চেষ্টা করলেও সন্ধ্যার পরে ওরা আমাকে মনে করাইয়া দেয়যখন ওরা আপন মনে চিৎকার করে আবার কেউ অদ্ভুত স্বরে গানও গায়।
মহা হৈ চৈ জেলের ভিতর। কারণ জেলের আইজি সাহেব ঢাকা জেল দেখতে আসবেন আগামীকাল। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে কয়েদিদের। চুনা লাগানো হবে। জনাব নিয়ামতুল্লা আইজি হবার পূর্বে এই জেলেই সুপারিনটেনডেন্ট এবং ডিআইজি ছিলেন। তিনি ময়লা আবর্জনা দেখলে ক্ষেপে যান—সকলেই জানে। চমৎকার ব্যবহার, অমায়িক, ভদ্র, কোনো কয়েদি কষ্ট পাক এ তিনি চান না। আমি নিজেই দু’বার তার সময়ে এই জেলে এসেছি। আমার সাথে তার পরিচয় ছিল। এবারও যখন জেলে এসেছি তিনি খবর পেয়েই আমাকে দেখতে এসেছিলেন। তিনি সকল কয়েদিদেরই সুবিধা অসুবিধা দেখতেন। আমার দিকে তিনি ব্যক্তিগত নজর দিতেন। সাধারণ কয়েদিরা তাকে ভয়ও করে এবং ভক্তিও করে। কাহাকেও তিনি অন্যায়ভাবে কষ্ট দিতেন না। কয়েদিদের খাওয়া ও কাপড়ের দিকে নজর দিতেন। তিনি জেল দেখতে এসে আমার কাছে এলেন, বসলেন। আমার কিছু বলার আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি সাধারণত কিছু বলি না, কারণ নিজের ইজ্জত নিয়ে থাকতে পারলেই বেঁচে যাই। আমি বললাম, ভালই আছি। ডিপিআরের রাজনৈতিক বন্দিদের অসুবিধার কথা বললাম। ’এ’ ‘বি’ ‘সি’ ভাগ না করে এক ক্লাশই করলে ভাল হয়। প্রায় সকলকেই সি’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। দেড় টাকায় কি করে চলতে পারে খাবার, নাস্তা, চা ইত্যাদি। আবার কিছুই বাড়ি থেকে আনতে দিবে না। মাসে পাঁচ টাকা দেয় কাগজ, দাঁতন, সাবান, তোয়ালে ইত্যাদি কিনতে। একটা খবরের কাগজ কিনতে তো ছয় টাকা লাগে মাসে। তার সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও কিছু করার নাই, কারণ সরকারের হুকুম।
পাগলদের ৪০ সেল দেখাইয়া বললাম, দেখেন জেলের মধ্যে কি অবস্থা, আমাদের মত হতভাগাদের কি অসুবিধা হয়। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, কি করা যাবে, এতগুলি পাগল কোথায় রাখব? ব্যবস্থা তো নাই। আমি বললাম, চিন্তা করবেন না, প্রথম বেশ কষ্ট হয়েছিল। এখন সয়ে গেছে। সেলগুলির কথা বললাম। দশ সেল, পুরানা বিশ সেল, নূতন বিশ সেলে রাজনৈতিক বন্দিদের অসুবিধার কথাও বললাম। সাধারণ কয়েদিদের বিষয় আলোচনা হলো। তিনি বললেন, আপনাকে তো একলাই রাখা হয়েছে। বললাম, আপনারা কি করবেন, উপায় নাই যে। বড়কর্তারা’ হুকুম দিয়েছে একাই থাকতে হবে। তিনি বললেন, ‘দেখি চেষ্টা করে কিছু করা যায় কিনা। তাঁর সহানুভূতি থাকলেই বা কি হবে! পূর্ব বাংলার মোতয়াল্লি সাহেবের নজর বড় খারাপ আমার ও আমার পার্টির কর্মীদের উপর। জেলের ভিতরও যাতে কষ্ট পাই তার চেষ্টা তিনি করেন। আইজি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি আমার বইপড়ার কাজে মন দিলাম।
২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭ ॥ ৮ই ফাল্গুন
আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ঠিক পনের বছর আগে সেদিন ছিল বাংলা ১৩৫৮ সালের ৮ই ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার, ইংরেজি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য শহীদ হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বীর সন্তান : ১। আবদুস সালাম, ২। আবদুল জব্বার, ৩। আবুল বরকত, ৪। রফিকউদ্দিন। আহত হয়েছিলেন অনেকেই। ঠিক পনের বৎসর পূর্বে এইদিনে আমিও জেলে রাজবন্দি ছিলাম ফরিদপুর জেলে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করি। জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানেই ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনশন করব আর ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিবস পালন করা হবে বলে স্থির হয়। আমাকে আবার জেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো চিকিৎসা না করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি আমাকে ও মহিউদ্দিনকে ফরিদপুর জেলে চালান দেওয়া হলো। মহিউদ্দিনও আমার সাথে অনশন করবে স্থির করে দরখাস্ত দিয়েছিল।
আজ ঠিক পনের বৎসর পরেও এই দিনটাতে আমি কারাগারে বন্দি।