তারবার্তায় জাতীয় সংহতির স্বার্থে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান ও দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান হয়।
এই তারবার্তা আমার কাছে পৌঁছায় নাই। কারণ আমাকে আইবি ডিপার্টমেন্ট দিবে না। কোনো কাগজপত্র চিঠি বই খাতা যদি আনতে হয় তবে এদের মাধ্যমে আসবে। ইচ্ছা করলে না দিয়াও পারে। বলবার কিছুই নাই। এমনকি স্ত্রীর সাথে বা ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে হলে গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী সামনে বসে থাকবে, কোনো রাজনৈতিক কথা বলি কিনা শুনবে।
যখন প্রবাসী পাকিস্তানিরাও অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে এবং ন্যায্য দাবি সমর্থন করিতে শুরু করিয়াছে তখন সাফল্যের আর বেশি দিন নাই। বন্ধুদের তারবার্তার উত্তর যখন দিতে পারলাম না, তখন নীরবে তাদের মঙ্গল কামনা করি। আর প্রতিজ্ঞা করি হতভাগা ভাইদের রক্তকে বৃথা যেতে দিব না।
সাড়ে চারটায় জেলের লোক এসে বলল-চলুন আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না—যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়। ছোট মেয়েটার শুধু একটা আবদার। সে আমার কাছে থাকবে। আর কেমন করে কোথায় থাকি তা দেখবে। সে বলে, থেকে যেতে রাজি আছি। রেণু বলল, মাকে আমার ছোট ভাই খুলনা নিয়ে গেছে। একটু ভালর দিকে। ঢাকা আনা সম্ভব হবে না সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। হাচিনার কলেজ বন্ধ, তাই খুলনা যেতে চায়। বললাম, যেতে দাও মা’র একটু খেদমত হবে। জামালের শরীর খারাপ, গলা ফুলে রয়েছে। এ বড় খারাপ ব্যারাম। রেণুকে তাই বললাম, ডাক্তার দেখাইও। স্কুলে যেতে পারবে না। এছাড়াও আরো অনেক কথা হলো।
রাশেদ মোশাররফ ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক। আমার বাড়ির কাছে থাকে। তাহার বিবাহের তারিখ ১২ই জুন ঠিক ছিল, বিবাহের কার্ডও ছাপান হয়েছিল। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে আনা হয়েছে। রেণু দুঃখ করে বলল, সে তো বিবাহ নিয়াই ব্যস্ত ছিল, তাকে যে কেন ধরে এনেছে! এদের গ্রেপ্তারের কোনো তাল নাই। ছোট ছোট দুধের বাচ্চাদের ধরে নিয়ে এসেছে রাস্তা থেকে, রাতভর মা মা করে কাঁদে। একজন মহিলা, এক ভদ্রলোকের বাড়িতে কাজ করে। এরই মাধ্যমে সংসার চালায়, বড় গরিব। তার ছয় বৎসরের ছেলেকে নিয়ে চলেছে সেই বাড়িতে কাজ করতে। গাড়ি থামাইয়া পুলিশ ডাক দেয়, এই ছেলে শোন। ছেলেটি এগিয়ে গেছে, তাকেও গাড়িতে উঠাইয়া নিয়েছে। মহিলাটি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। কে কার কথা শোনে! একেবারে জেলে নিয়ে এসেছে। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। মোনায়েম খান সাহেবের দৌলতে।
প্রায় এক ঘন্টা রেণু এবং আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছিলাম। সংসারের ছোটখাট আলাপ। ওদের বলেছি আর কোনো কষ্ট নাই; একাকী সঙ্গীবিহীন আছি। মানিক ভাইকে বলতে বললাম, তিনি যেন চীফ সেক্রেটারিকে বলেন কেন এই অত্যাচার? আমার স্ত্রী বলল, মানিক ভাইর সাথে দেখা করব। সাক্ষাতের সময় শেষ হয়ে গেছে আর দেরি করা চলে না। তাই বিদায় দিলাম ওদের। রাসেলকে গাড়ির কথা বলে কামালের কাছে দিয়ে সরে এলাম।
কে বুঝবে আমাদের মতো রাজনৈতিক বন্দিদের বুকের ব্যথা। আমার ছেলেমেয়েদের তো থাকা খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না। এমন অনেক লোক আছে যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে, এমনকি ইজ্জত দিয়েও সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দির স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে-করুণ কাহিনী কল্পনা করতেও ভয় হয়।
যারা স্বার্থের জন্য আমাদের বৎসরের পর বৎসর কারাগারে বন্দি করে রেখেছ কিছুদিন যে ক্ষমতায় ছিলাম তখন তাদের কাহাকেও গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি করে রাখি নাই। এমনকি জেলগেটে এসে রাজবন্দিদের মুক্তি দিয়েছিলাম।
এখানকার স্বৈরশাসকদের বি. টীম ও সি. টীম এখন অন্য ভোল্ ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তারাই আজ জুলুম করছে আমাদের উপর। যদি কিছুদিনের জন্য জেল দিয়ে সেলের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা দরজা বন্ধ করে রেখে একবার লছমি খাবার দিতাম, তবে জীবনেও আর রাজনীতির নাম নিত না। জেল বন্দি করার সাথে বন্ড দিয়া বাহির হয়ে যেত। অথচ এমন অনেক রাজবন্দি এখনও জেলে আছে, যারা প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে; হাঁটতে চলতেও পারে না, খেয়ে হজম করতেও পারে না। প্রায় ১৩/১৪ বৎসর—পাকিস্তান হওয়ার পরেই জেলে আছে। তারা জানে জেলেই তাদের মরতে হবে বোধ হয়, তবুও বন্ড দেয় নাই। এই সমস্ত ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাদেরও আমরা শ্রদ্ধা করি। এঁদের উপর যারা জুলুম করে, তারা কত বড় নিষ্ঠুর হতে পারে তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমার ভাষা নাই তাই লিখতে পারলাম না।
আবার কারাগারের ক্ষুদ্র কুঠুরিতে ফিরে এসে অপেক্ষা করতে থাকি জমাদার সাহেবের আগমনের জন্য। তালাবন্ধ হতে হবে। যথারীতি আমার গুহার মধ্যে রাতের জন্য শুভাগমন করিয়া তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললাম।