২০.
দেড় মাস পরে আমি কলকাতায় হাজির হলাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে। বেকার হোস্টেলে এসেই আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার জ্বর মোটেই ছাড়ছিল না। শহীদ সাহেব খবর পেয়ে এত কাজের ভিতরেও আমার মত সামান্য কর্মীর কথা ভোলেন নাই। ট্রপিক্যাল স্কুল অব মেডিসিনের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে আমার জন্য সিট ঠিক করে খবর পাঠিয়ে দিলেন। পনের দিন হাসপাতালে ছিলাম, তিনি ফোন করে প্রিন্সিপালের কাছ থেকে খোঁজ নিতেন। সেই জন্যই প্রিন্সিপাল আমাকে দেখতে আসতেন। আমি ভাল হয়ে আবার হোস্টেলে ফিরে এলাম।
আসানসোলে ইউরোপিয়ান ভদ্রমহিলার কাছ থেকে এবং নিজ হাতে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম, পরবর্তী জীবনে তা আমার অনেক উপকার করেছিল, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে। এই সময় মনস্থির করলাম, আমাকে বিএ পরীক্ষা দিতে হবে। ড. জুবেরী আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন, তার সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, “তুমি যথেষ্ট কাজ করেছ পাকিস্তান অর্জন করার জন্য। তোমাকে আমি বাধা দিতে চাই না। তুমি যদি ওয়াদা কর যে এই কয়েক মাস লেখাপড়া করব এবং কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যাবা এবং ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেই এসে পরীক্ষা দিবা, তাহলে তোমাকে আমি অনুমতি দিব।” তখন টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমি ওয়াদা করলাম, প্রফেসর তাহের জামিল, প্রফেসর সাইদুর রহমান এবং প্রফেসর নাজির আহমদের সামনে। আমি অনুমতি নিয়ে আমার এক বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী—তার নাম ছিল শেখ শাহাদাত হোসেন, ১৯৪৬ সালে বিএ পাস করেছে, এখন হাওড়ার উল্টোডাঙ্গায় চাকরি করে, ওর কাছে চলে গেলাম, সমস্ত বইপত্র নিয়ে।
পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে কলকাতায় চলে আসি। হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি। আমার ছোটবোনের স্বামী বরিশালের এডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবাত তখন পার্ক সার্কাসে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। আমার বোনও থাকত, তার কাছেই উঠলাম। কিছুদিন পরে রেণুও কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।
শেখ শাহাদাত হোসেন দুই মাসের ছুটি নিয়ে আমাকে পড়তে সাহায্য করেছিল। পরে জীবনে অনেক ক্ষতি আমার সে করেছে। এর জন্য তাকে কোনোদিনই কিছু বলি নাই। ওর বাড়ি আমার বাড়ির কাছাকাছি।
২১-৩০. হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হতে চাইলেন
হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হতে চাইলেন। কারণ, মওলানা আকরম খাঁ সাহেব পদত্যাগ করেছিলেন। শহীদ সাহেব রাজি হন নাই। মওলানা সাহেবকে অনুরোধ করে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিয়েছিলেন। হাশিম সাহেব রাগ করে লীগ সেক্রেটারি পদ থেকে ছুটি নিয়ে বর্ধমানে চলে গিয়েছিলেন। যখন তিনি কলকাতা আসতেন মিল্লাত প্রেসেই থাকতেন। হাশিম সাহেব এই সময় ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অনেক হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমাদের অনেকেরই মোহ তার উপর থেকে ছুটে গিয়েছিল।
সে অনেক কথা। তিনি কলকাতা আসলেই শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতেন। এর প্রধান কারণ ছিল মিল্লাত কাগজকে দৈনিক করতে সাহায্য না করে তিনি দৈনিক ইত্তেহাদ কাগজ বের করেছিলেন—নবাবজাদা হাসান আলী সাহেবের ব্যবস্থাপনা এবং আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের সম্পাদনায়। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের দৈনিক আজাদও ক্ষেপে গিয়েছিল শহীদ সাহেবের উপর। কারণ, পূর্বে একমাত্র আজাদ ছিল মুসলমানদের দৈনিক। এখন আর একটা কাগজ বের হওয়াতে মওলানা সাহেব যতটা নন তার দলবল খুব বেশি রাগ করেছিল।
১৯৪৬ সালের শেষের দিকে ভারতের রাজনীতিতে এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার বদ্ধপরিকর, যে কোনোমতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মুসলিম লীগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস প্রথমে গ্রহণ করে পরে পিছিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে বড়লাট লর্ড ওয়েভেল ঘোষণা করলেন। লর্ড ওয়েভেল মুসলিম লীগের সাথে ভাল ব্যবহার না করায়, মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করতে অস্বীকার করে। কংগ্রেস পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে সরকারে যোগদান করে। যদিও লর্ড ওয়েভেল ঘোষণা করেছিলেন, মুসলিম লীগের জন্য পাঁচটা মন্ত্রিত্বের পদ খালি রইল, ইচ্ছা করলে তারা যে কোন মুহূর্তে যোগদান করতে পারে। সরকারে যোগদান না করে একটু অসুবিধায় পড়েছিল মুসলিম লীগ। শেষ পর্যন্ত জনাব সোহরাওয়ার্দী লর্ড ওয়েভেলের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলিম লীগ যাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করতে পারে সেই সম্বন্ধে আলোচনা করেন। মি. জিন্নাহ তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন আলোচনা চালাতে। শেষ পর্যন্ত জিন্নাহ-ওয়েভেল আলোচনা করে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করতে রাজি হয়। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে লিয়াকত আলী খান, আই আই চুন্দ্রিগড়, আবদুর রব নিশতার, রাজা গজনফর আলী খান এবং যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মুসলিম লীগের তরফ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন ভারত সরকারে যোগদান করেন। মুসলিম লীগ যদি কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদান না করত তবে কংগ্রেস কিছুতেই পাকিস্তান দাবি মানতে চাইত না।
১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করা হল ভারতবর্ষ ভাগ হবে। কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এই জন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। বাংলাদেশের কলকাতা এবং তার আশপাশের জেলাগুলিও ভারতবর্ষে থাকবে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন। বর্ধমান ডিভিশন আমরা না-ও পেতে পারি। কলকাতা কেন পাব না? কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃষ্টি করতে শুরু করল। আমরাও বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না, এর জন্য সভা করতে শুরু করলাম। আমরা কর্মীরা কি জানতাম যে, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এই ভাগের ফলা? বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা। আজ দেখা যাচ্ছে, মাত্র আসামের এক জেলা—তাও যদি গণভোটে জয়লাভ করতে পারি। আর বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাগুলি কেটে হিন্দুস্থানে দেওয়া হবে। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম। কলকাতার কর্মীরা ও পশ্চিমবঙ্গের কর্মীরা এসে আমাদের বলত, তোমরা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, আমাদের কপালে কি হবে খোদাই জানে! সত্যই দুঃখ হতে লাগল ওদের জন্য। গোপনে গোপনে কলকাতার মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল, যা হয় হবে, কলকাতা ছাড়া হবে না। শহীদ সাহেবের পক্ষ থেকে বাংলা সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেছিলেন, কলকাতা আমাদের রাজধানী থাকবে। দিল্লি বসে অনেক পূর্বেই যে কলকাতাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে একথা তো আমরা জানতামও না, আর বুঝতামও না।।