আমি নিজেও খুব চিন্তাযুক্ত ছিলাম। কারণ, আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে পাঁচজনই তখন কলকাতা ও শ্রীরামপুরে। আমার মেজোবোনের জন্য চিন্তা নাই, কারণ সে বেনিয়া পুকুরে আছে। সেখানে এক বোন বেড়াতে এসেছে। এক বোন শ্রীরামপুরে ছিল। একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের ম্যাট্রিক পড়ে। একেবারে ছেলেমানুষ। একবার মেজো জনের বাড়ি, একবার আমার ছোটবোনের বাড়ি এবং মাঝে মাঝে আমার কাছে বেড়িয়ে বেড়ায়। কারো কথা বেশি শোনে না। খুবই দুষ্ট ছিল ছোটবেলায়। নিশ্চয়ই গড়ের মাঠে এসেছিল। আমার কাছে ফিরে আসে নাই। বেঁচে আছে কি না কে জানে! শ্রীরামপুরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে পাড়ায় আমার বোন থাকে, সে পাড়ায় মাত্র দুইটা ফ্যামিলি মুসলমান।
কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়! এক এক করে খবর নিতে চেষ্টা করলাম। ছোট ভগ্নিপতি হ্যারিসন রোডে টাওয়ার লজে থাকে। সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে যেয়ে খবর নিলাম, সে চলে গেছে কারমাইকেল হোস্টেলে। নাসের মেজোবোনের কাছেও নাই, আমার কাছেও নাই। আমার সবচেয়ে ছোট ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেনকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, “নাসের ভাই ১৬ই আগস্ট আমার এখানে এসেছিল, থাকতে বললাম থাকল না, আমিও জোর করলাম না। কারণ আমার জায়গাটাও ভাল না। আমাদেরও পালাতে হবে।”
তারপরে আর খোঁজ নাই, কি করে খবর নিই! লেডী ব্র্যাবোর্ন কলেজে রিফিউজিদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দোতলায় মেয়েরা, আর নিচে পুরুষরা। কর্মীদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আমাকেও মাঝে মাঝে থাকতে হয়। মুসলমানদের উদ্ধার করার কাজও করতে হচ্ছে। দু’এক জায়গায় উদ্ধার করতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদেরও উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। মনে হয়েছে, মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে। প্রথম দিন ১৬ই আগস্ট মুসলমানরা ভীষণভাবে মার খেয়েছে। পরের দুই দিন মুসলমানরা হিন্দুদের ভীষণভাবে মেরেছে। পরে হাসপাতালের হিসাবে সেটা দেখা গিয়েছে।
এদিকে হোস্টেলগুলিতে চাউল, আটা ফুরিয়ে গিয়েছে। কোন দোকান কেউ খোলে, লুট হয়ে যাবার ভয়েতে। শহীদ সাহেবের কাছে গেলাম। কি করা যায়? শহীদ সাহেব বললেন, “নবাবজাদা নসরুল্লাহকে (ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ সাহেবের ছোট ভাই, খুব অমায়িক লোক ছিলেন, শহীদ সাহেবের ভক্ত ডেপুটি চিফ হুইপ ছিলেন) ভার দিয়েছি, তার সাথে দেখা কর।” আমরা তার কাছে ছুটলাম। তিনি আমাদের নিয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে গেলেন এবং বললেন, “চাউল এখানে রাখা হয়েছে তোমরা নেবার বন্দোবস্ত কর। আমাদের কাছে গাড়ি নাই। মিলিটারি নিয়ে গিয়েছে প্রায় সমস্ত গাড়ি। তবে দেরি করলে পরে গাড়ির বন্দোবস্ত করা যাবে। আমরা ঠেলাগাড়ি আনলাম, কিন্তু ঠেলবে কে? আমি, নূরুদ্দিন ও নূরুল হুদা (এখন ডিআইটির ইঞ্জিনিয়ার) এই তিনজনে ঠেলাগাড়িতে চাউল বোঝাই করে ঠেলতে শুরু করলাম। নূরুদ্দিন সাহেব তো তালপাতার সেপাই’শরীরে একটুও বল নাই। আমরা তিনজনে ঠেলাগাড়ি করে বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেলে চাউল পৌঁছে দিলাম। এখন কারমাইকেল হোস্টেলে কি করে পৌঁছাই? অনেক দূর, হিন্দু মহল্লা পার হয়ে যেতে হবে। ঠেলাগাড়িতে পৌঁছান সম্পূর্ণ অসম্ভব। নূরুদ্দিন চেষ্টা করে একটা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি জোগাড় করে আনল। আমরা তিনজন কিছু চাল নিয়ে কারমাইকেল হোস্টেলে পৌঁছে ফিরে আসলাম।
শ্রীরামপুরে কোনো গোলমাল হয় নাই শুনলাম, কিন্তু নাসের কোথায়? লোক পাঠালাম শ্রীরামপুরে খবর আনতে। দাঙ্গা ও লুটতরাজ একটু বন্ধ হয়েছে। নাসের কলকাতায় এসেছিল ১৬ই আগস্ট। হ্যারিসন রোডে এসে বিপদে পড়ে। তারপর একটা এ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে উঠে জীবনটা বাঁচায়। মাসেরের একটা পা ছোটকালে টাইফয়েড হয়ে খোড়া হয়ে গিয়েছিল। পা টেনে টেনে হাঁটতে হয়। সেই পা দেখিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ে। দিনভর এ্যাম্বুলেন্সে থাকে, সন্ধ্যায় হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে শ্রীরামপুর যায়। ট্রেনে তিন ঘণ্টা লাগে। কয়েকবার ট্রেনে আক্রমণ হয়েছে। কোনোমতে বেঁচে গিয়েছে। একটা কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আবার অনেক মুসলমান হিন্দু পাড়াপড়শীকে রক্ষা করতে যেয়ে জীবন দিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ পেয়েছি। মুসলিম লীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত, তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে, শীঘ্রই এদের নিয়ে যেতে বলেছে, নতুবা এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে।
একদল লোককে দেখেছি দাঙ্গাহাঙ্গামার ধার ধারে না। দোকান ভাঙছে, লুট করছে, আর কোনো কাজ নাই। একজনকে বাধা দিতে যেয়ে বিপদে পড়েছিলাম। আমাকে আক্রমণ করে বসেছিল। কারফিউ জারি হয়েছে, রাতে কোথাও যাবার উপায় নাই। সন্ধ্যার পরে কোন লোক রাস্তায় বের হলে আর রক্ষা নাই। কোন কথা নাই, দেখামাত্র শুধু গুলি। মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলে দেয়। এমনকি জানালা খোলা থাকলেও গুলি করে। ভোরবেলা দেখা যেত অনেক লোক রাস্তায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। কোনো কথা নেই শুধু গুলি।
একবার আমার ও সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরীর (এখন কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএনএ) উপর ভার পড়েছে রাতে পার্ক সার্কাস ও বালিগঞ্জের মাঝে একটা মুসলমান বস্তি আছে-প্রত্যেক রাতেই হিন্দুরা সেখানে আক্রমণ করে—তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য। কারণ, বন্দুক চালানোর লোকের নাকি অভাব। আমি ও মোয়াজ্জেম বন্দুক চালাতে পারতাম। আমার ও মোয়াজ্জেমের বাবার বন্দুক ছিল। আমরা গুলি ছুঁড়তে জানতাম।