১৭.
কনভেনশন সমাপ্ত হওয়ার পরে যারা হাওড়া স্টেশনে আমাদের বিদায় জানাতে এসে ট্রেনে উঠে পড়েছিল তারা মহাবিপদের সম্মুখীন হল। কি করে কলকাতা ফিরে আসবে? স্পেশাল ট্রেন তো আর কলকাতা ফিরে যাবে না। কি করি, ভেবে আর কূল পাই না। আমরা পূর্ব থেকে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম দিল্লি থেকে আজমীর শরীফে খাজাবাবার দরগাহ জিয়ারত কর, আবার আজমীর থেকে আগ্রায় তাজমহল দেখতে যাব। ১৯৪৩ সালে তাজমহল না দেখে ফিরে যেতে হয়েছিল। এবার যেভাবে হয় দেখতেই হবে। ছোটকাল থেকে আশা করে রয়েছি, সুযোগ আবার কখন হবে কে জানে? যাহোক, আমি ও আরও কয়েকজন সহকর্মী শহীদ সাহেবের শরণাপন্ন হলাম এবং ছাত্রদের অসুবিধার কথা বললাম। শহীদ সাহেব বললেন, “কেন, একজন ভো টাকা নিয়ে গেছে, এদের ভাড়া দেবার কথা বলে। তোমার সাথে আলোচনা করে টাকা দিতে বলেছি।” বললাম, “জানি না তো স্যার, সে তো চলে গিয়েছে। শহীদ সাহেব রাগ করলেন। তিনি ছাত্র নন, তার নাম আজ আর আমি বলতে চাই না। শহীদ সাহেব আবারও কিছু টাকা দিলেন। হিসাব করে প্রত্যেককে পঁচিশ টাকা করে, এতেই হয়ে যাবে। খন্দকার নূরুল আলম ও আমি সকলকে পঁচিশ টাকা করে দিয়ে রসিদ নিয়ে নিলাম, প্রত্যেকের কাছ থেকে। তারা বিদায় হয়ে কলকাতায় চলে গেল। আমরা আট-দশজন জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেবের সাথে আজমীর শরীফ রওয়ানা করলাম। চৌধুরী সাহেব সাথে আছেন, টাকার দরকার পড়লে অসুবিধা হবে না। আবার দিল্লি শহরকে ভাল করে দেখে নিলাম। শত শত বৎসর মুসলমানরা দিল্লি থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ শাসন করেছে। তখন কি জানতাম, এই দিল্লির উপর আমাদের কোনো অধিকার থাকবে না। দিল্লির লালকেল্লা, কুতুব মিনার, জামে মসজিদ আজও অনন্য মুসলিম শিল্পের নিদর্শন ঘোষণা করছে। পুরানা দিল্লি ও তার আশপাশে যখনই বেড়াতে গিয়েছি দেখতে পেয়েছি সেই পুরানা স্মৃতি।
আমরা দলেবলে আজমীর শরীফ যাবার উদ্দেশে ট্রেনে চড়ে বসলাম। কত গল্পই না শুনেছি বাড়ির গুরুজনদের কাছ থেকে। খাজাবাবার দরগায় গিয়ে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়, যদি চাওয়ার মত চাইতে পারো। আমরা যখন আজমীর শরীফ স্টেশনে পৌঁছালাম দেখি বহু লোক তাদের কাছে থাকবার জন্য আমাদের অনুরোধ করছিলেন। ভাবলাম, ব্যাপার কি? আমাদের এত আদর কেন? আমরা কারও দাওয়াত কবুল করছি না, কারণ চৌধুরী সাহেবই আমাদের প্রতিনিধি। তিনি যা করবেন তাই আমাদের করতে হবে। তিনি মালপত্র নিয়ে প্রথম শ্রেণী থেকে নেমে আসলেন এবং একজন ভদ্রলোককে বললেন, চলুন আপনার ওখানেই যাওয়া যাবে। তিনি তাড়াতাড়ি গাড়ি ডেকে আমাদের নিয়ে চললেন। আমাদের জন্য কামরার অভাব নাই। গোসল করলাম, খাওয়া-দাওয়া করলাম। পরে বুঝতে পারলাম, এরাই খাদেম। আজমীর শরীফের খাদেমদের যথেষ্ট
ভদ্রতাবোধ আছে দেখলাম, তারা কিছুই চেয়ে নেয় না। থাকার বন্দোবস্ত করবে, খাবার ব্যবস্থা করবে, সাথে লোক দেবে, যে খরচগুলি করার একটা নিয়ম আছে সেগুলিই শুধু আপনাকে দিতে হবে। ফিরে আসার সময় আপনারা যা দিবেন, তাই তারা গ্রহণ করবে। শুনেছি, যে টাকা তারা গ্রহণ করে, তার একটা অংশ নাকি দিতে হয় দরগাহ কমিটিকে। কারণ, দরগাহ কমিটির যথেষ্ট খরচ আছে। খাজাবাবার দরগায় কোন লোক না খেয়ে থাকে না। পাক হতে থাকে, মানুষ খেতে থাকে।
আমরা দরগায় রওয়ানা করলাম, পৌঁছে দেখি এলাহী কাণ্ড! শত শত লোক আসে আর যায়। সেজদা দিয়ে পড়ে আছে অনেক লোক। চিৎকার করে কাঁদছে, কারো কারো বা দুঃখে দুই চক্ষু বেয়ে পানি পড়ছে। সকলের মুখে একই কথা, ‘খাজাবাবা, দেখা দে।’ খাজাবাবার দরগার পাশে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান হচ্ছে। যদিও বুঝতাম না ভাল করে, তবুও মনে হত আরও শুনি। আমরা দরগাহ জিয়ারত করলাম, বাইরে এসে গানের আসরে বসলাম। অনেকক্ষণ গান শুনলাম, যাকে আমরা কাওয়ালী’ বলি। কিছু কিছু টাকা আমরা সকলেই কাওয়ালকে দিলাম। ইচ্ছা হয় না উঠে আসি। তবুও আসতে হবে। আমরা তারাগড় পাহাড়ে যাব, সেখানে কয়েকটি মাজার আছে। তারা খাজাবাবার খলিফা ছিলেন। তারাগড় পাহাড় অনেক উঁচুতে, আমাদের উঠতে হবে তার উপরে। কি করে এই পাহাড় অতিক্রম করে মুসলমান সৈন্যরা পৃথ্বীরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিল? সেই যুদ্ধে, যখন হাওয়াই জাহাজের জন্ম হয় নাই।
ইতিহাসের ছাত্রদের জানা আছে, খাজাবাবা কেনই বা এই জায়গা বেছে নিয়েছিলেন। সে ইতিহাসও খাদেম সাহেবের প্রতিনিধি আমাদের শোনাল। খাদেম সাহেব একজন প্রতিনিধি আমাদের সাথে দিয়েছিল। আমরা তারাগড়ে উঠলাম। অনেকক্ষণ সেখানে ছিলাম। তারাগড় পাহাড় থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায় শুধু মরুভূমি। আর একদিকে আজমীর শহর। সেখান থেকে নেমে আসলাম যখন তখন দুপুর পার হয়ে গেছে। আমরা খাদেম সাহেবের আস্তানায় এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার বেরিয়ে পড়লাম, আনার সাগরে যাবার উদ্দেশে।
বিরাট লেক, সকল পাড়েই শহর গড়ে উঠেছে আজকাল। একপাশে মোগল আমলের কীর্তি পড়ে আছে। এখানে এসে বাদশা ও বেগমরা বিশ্রাম করতেন। বাদশা শাহজাহানের কীর্তিই সকলের চেয়ে বেশি। বাদশা ও বেগম যেখানে থাকতেন সে জায়গাটা আজও আছে। সাদা মর্মর পাথরের দ্বারা তৈরি। আমরা সমস্ত সন্ধ্যা সেখানেই কাটালাম। সন্ধ্যার পর আস্তে আস্তে শহরের দিকে রওয়ানা করলাম। পানির দেশের মানুষ আমরা, পানিকে বড় ভালবাসি। আর মরুভূমির ভিতর এই পানির জায়গাটুকু ছাড়তে কত যে কষ্ট হয় তা কি করে বোঝাব! আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একজন বলেছিল, রাতটা এখানে কাটালে কেমন হয়? সত্যিই ভাল হত, কিন্তু উপায় নাই। রাতে কাউকেও থাকতে দেওয়া হয় না, এই জায়গাটায়। আবার থাকতে চেষ্টা করলে যদি পুলিশ বাহাদুররা গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তবে কে এই বির্ভূই বিদেশে আমাদের হাজত থেকে রক্ষা করবে।