নির্বাচনের পরে দেখা গেল একশত উনিশটার মধ্যে বোধহয় একশত ষোলটা সিট লীগ দখল করল। সংখ্যা দু’একটা ভুল হতে পারে, আমার ঠিক মনে নাই। এই একশত যোজনের মধ্যে নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলই বেশির ভাগ, যদিও তারা শহীদ সাহেবকে লিডার বানাতে বাধ্য হল, কিন্তু তলে তলে তাদের গ্রুপিং চলল। শহীদ সাহেব গ্রুপ করতেন না, তিনি উপযুক্ত দেখেই মন্ত্রী করলেন। নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলের অনেককে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ও হুইপ করলেন। জনাব ফজলুর রহমানকেও মন্ত্রী করলেন।
১৫.
যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে মিস্টার চার্চিল ভারতে ক্রিপস মিশন পাঠিয়ে ছিলেন, কিন্তু কোন ফল হয় নাই। যুদ্ধের পরে যখন মিস্টার ক্লিমেন্ট এটলি লেবার পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি ১৯৪৬ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে ক্যাবিনেট মিশন পাঠাবার কথা ঘোষণা করলেন; তাতে তিনজন মন্ত্রী থাকবেন, তারা ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন দলের সাথে পরামর্শ করে ভারতবর্ষকে যাতে তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা দেওয়া যায় তার চেষ্টা করবেন। ভারতবর্ষে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি হয় একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে—বড়লাটের সাথে পরামর্শ করে। এই ক্যাবিনেট মিশনের সদস্য ছিলেন, লর্ড পেথিক লরেন্স, সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, প্রেসিডেন্ট অব দ্য বোর্ড অব ট্রেড এবং মিস্টার এ, ভি, আলেকজান্ডার, ফার্স্ট লর্ড অব এডমাইরালটি (Lord Pethick Lawrence, Secretary of State for India, Sir Stafford Cripps, President of the Board of Trade, and A. v. Alexander, First Lord of the Admiralty)—এরা ভারতবর্ষে এসে বড় লাটের সাথে এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে পরামর্শ করে একটা কর্মপন্থা অবলম্বন করবেন। মিস্টার এটলির বক্তৃতায় মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির কথা উল্লেখ তো নাই-ই বরং সংখ্যালঘুদের দাবিকে তিনি কটাক্ষ করেছিলেন। মিস্টার এটলি তার বক্তৃতার এক জায়গায় যা বলেছিলেন, তাই তুলে দিলাম: “Mr. Atlee declares that minorties cannot be allowed to impede the progress of majorities.” মিস্টার এটলির বক্তৃতায় কংগ্রেস মহল সন্তোষ প্রকাশ করলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা করলেন।
ক্যাবিনেট মিশন ২৩শে মার্চ তারিখে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছালেন। তারা ভারতবর্ষে এসে যে সকল বিবৃতি দিলেন তাতে আমরা একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা দলবল বেঁধে শহীদ সাহেবের কাছে যেতাম, তাকে বিরক্ত করতাম, জিজ্ঞাসা করতাম, কি হবে? শহীদ সাহেব শান্তভাবে উত্তর দিতেন, “ভয়ের কোন কারণ নাই, পাকিস্তান দাবি ওদের মানতেই হবে। আমরা দিনেরবেলা তাঁর দেখা পেতাম খুব অল্পই, তাই রাতে এগারটার সময় নূরুদ্দিন ও আমি যেতাম। কথা শেষ করে আসতে আমাদের অনেক রাত হয়ে যেত।
আমরা প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে থিয়েটার রোড থেকে বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম। দু’একদিন আমরা রিপন স্ট্রিটে মিল্লাত অফিসে এসে চেয়ারেই শুয়ে পড়তাম। মিল্লাত কাগজের জন্য নতুন প্রেস হয়েছে, অফিস হয়েছে, হাশিম সাহেব সেখানেই থাকতেন। খন্দকার নূরুল আলম তখন মিল্লাত কাগজের ম্যানেজার হয়েছেন। তখন লীগ অফিসের থেকে আমাদের আলোচনা সভা মিল্লাত অফিসেই বেশি হত। মুসলিম লীগ অফিসে এমএলএরা ও মফস্বলের কর্মীরা এসে থাকতেন। বরিশালের ফরমুজুল হক সাহেব মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি অফিসেই তার ফ্যামিলি নিয়ে থাকতেন। শহীদ সাহেব তাকে মাসে মাসে বেতন দিতেন।
১৬.
হঠাৎ খবর আসল, জিন্নাহ সাহেব ৭, ৮, ৯ এপ্রিল দিল্লিতে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলিম লীগপন্থী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশন ডেকেছেন। বিগত নির্বাচনে বাংলাদেশ ও মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলিতে মুসলিম লীগ একচেটিয়াভাবে জয়লাভ করেছে। তবে অধিকাংশ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে নাই। তাই শুধুমাত্র বাংলাদেশে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন হয়েছে। পাঞ্জাবে খিজির হায়াত খান তেওয়ানার নেতৃত্বে ইউনিয়নিস্ট সরকার, সীমান্তে ডা, খান সাহেবের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার, সিন্ধুতে জনাব আল্লাহ বক্সের নেতৃত্বে মুসলিম লীগবিরোধী সরকার গঠিত হয়েছে। চারটা মুসলমান সংখ্যাগুরু প্রদেশের মধ্যে মাত্র বাংলাদেশেই এককভাবে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করেছে। অন্যান্য প্রদেশে মুসলিম লীগবিরোধী দল হিসাবে আসন গ্রহণ করেছে। সমস্ত ভারতবর্ষে তখন এগারটা প্রদেশ ছিল।
শহীদ সাহেব স্পেশাল ট্রেনের বন্দোবস্ত করতে হুকুম দিলেন। বাংলা ও আসামের মুসলিম লীগ এমএলএ ও কর্মীরা এই ট্রেনে দিল্লি যাবেন। ট্রেনের নাম দেওয়া হল ‘পূর্ব পাকিস্তান স্পেশাল’। হাওড়া থেকে ছাড়বে। আমরাও বাংলাদেশ থেকে দশ-পনেরজন ছাত্রকর্মী কনভেনশনে যোগদান করব। এ ব্যাপারে শহীদ সাহেবের অনুমতি পেলাম। সমস্ত ট্রেনটাকে সাজিয়ে ফেলা হল মুসলিম লীগ পতাকা ও ফুল দিয়ে। দুইটা ইন্টারক্লাস বগি আমাদের জন্য ঠিক করে ফেললাম। ছাত্ররা দুষ্টামি করে বগির সামনে লিখে দিল, ‘শেখ মুজিবর ও পার্টির জন্য রিজার্ভড’; এ লেখার উদ্দেশ্য হল, আর কেউ এই ট্রেনে যেন না ওঠে। আর আমার কথা শুনলে শহীদ সাহেব কিছুই বলবেন না, এই ছিল ছাত্রদের ধারণা। যদিও ছাত্রদের নেতা ছিল নূরুদ্দিন। তাকেই আমরা মানতাম।