আবার শহীদ সাহেব মাদারীপুর হয়ে গোপালগঞ্জ এলেন জনমত যাচাই করতে। অনেক লোক ইলেকশনে দাঁড়াতে চায়, কার বেশি জনপ্রিয়তা দেখতে হবে। পূর্বেকার এমএলএ খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ সাহেবও মুসলিম লীগে চলে এসেছেন, পেনশনপ্রাপ্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার খান বাহাদুর সামসুদ্দোহা, আবদুস সালাম খান সাহেব এবং আরও দুই একজন ছিলেন। সালাম সাহেব ব্যক্তিগতভাবে গোপালগঞ্জে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। শতকরা আশি ভাগ লোকই তাকে চায়। সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না। আমার আব্বাকে শহীদ সাহেব জিজ্ঞাসা করলে আব্বা বলেছিলেন, সালাম সাহেবকে লোকে চায়। তবে সালাম সাহেব ও খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব উভয়ই উপযুক্ত প্রার্থী। শহীদ সাহেব বললেন আমাকে, জনসাধারণ তো সালাম সাহেবকে চায়, তোমার আব্বাও তো তাকে সমর্থন করেন। আমি বললাম, যাকে লোকে চায়, তাকেই দিবেন, আমার কোনো আপত্তি নাই। এর পূর্বেই সালাম সাহেবের সাথেও আমার কথা হয়েছিল। কিন্তু হাশিম সাহেব কিছুতেই রাজি হলেন না। এর কারণ জানি না। শেষ পর্যন্ত আমিও হাশিম সাহেবকে বলেছিলাম, সালাম সাহেবকে নমিনেশন দিতে। সেজন্য আমার উপর রাগ করেছিলেন তিনি। শহীদ সাহেব রিপোর্ট দিলেন, সালাম সাহেবই সকলের চেয়ে জনপ্রিয়। তিনি সালাম সাহেবকে নমিনেশন দিতে প্রস্তাব করেছিলেন। লাল মিয়া ও হাশিম সাহেব বেঁকে বসলেন। এই সময় কিছু টাকা পয়সার ছড়াছড়ি হচ্ছিল। আমি খবর পেতাম, যদিও চোখে দেখি নাই। শেষ পর্যন্ত খান বাহাদুর সামসুদ্দোহা সাহেবকে নমিনেশন দিল প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি বোর্ড। কেন্দ্রীয় বোর্ড খান বাহাদুর সাহেবকে কেটে দিয়ে খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদকে নমিনেশন দিল। সালাম সাহেব ইলেকশন করলে বোধহয় নির্বাচিত হতে পারতেন, কিন্তু মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করলেন না। কারণ পাকিস্তানের উপর ভোট। খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদও নমিনেশন পেতে পারেন না, কারণ মাত্র কয়েক মাস পূর্বে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি মুসলিম লীগের নমিনেশন পেলেন কারণ তার চাচাতো ভাই খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবের মেয়েকে বিবাহ করেন। তাই নাজিমুদ্দীন সাহেব, চৌধুরী খালিকুজ্জামান সাহেবকে বলে নমিনেশন নিয়ে আসেন।
শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিল না, দল মত দেখতেন না, কোটারি করতে জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ, তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তাঁর সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এজন্য তাঁকে বার বার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।
আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।
অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।
বাঙালিরা শহীদ সাহেবকে প্রথম চিনতে পারে নাই। যখন চিনতে পারল, তখন আর সময় ছিল না। নির্বাচনের সব খরচ, প্রচার, সংগঠন তাকেই এককভাবে করতে হয়। টাকা বোধহয় সামান্য কিছু কেন্দ্রীয় লীগ দিয়েছিল, বাকি শহীদ সাহেবকেই জোগাড় করতে হয়েছিল। শত শত সাইকেল তাকেই কিনতে হয়েছিল। আমার জানা মতে পাকিস্তান হয়ে যাবার পরেও তাঁকে কলকাতায় বসে দেনা শোধ করতে হয়। আমি পূর্বেই বলেছি, শহীদ সাহেব সরল লোক ছিলেন। তিনি ধোঁকায় পড়ে গেলেন। পার্লামেন্টারি বোর্ডে তাঁর দল সংখ্যাগুরু থাকা সত্ত্বেও নিজের লোককে তিনি নমিনেশন দিতে পারলেন না। নাজিমুদ্দীন সাহেবের দল পরাজিত হওয়ার পরে তারা অন্য পন্থা অবলম্বন করলেন। ঘোষণা করলেন, তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না অর্থাৎ শহীদ সাহেবই দলের নেতা হবেন। তিনি শহীদ সাহেবকে অনুরোধ করলেন যারা পূর্ব থেকে মুসলিম লীগে আছে তাদের নমিনেশন দেওয়া হোক, কারণ এরা সকলেই শহীদ সাহেবকে সমর্থন করবেন। খাজা সাহেব যখন নির্বাচন করবেন না তখন আর ভয় কি? শহীদ সাহেব এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে পুরানা এমএলএ প্রায় সকলকেই নমিনেশন দিয়ে দেন। বোধহয় তখন বাংলাদেশে একশত উনিশটা সিট মুসলমানদের ছিল। এই চাতুর্যে প্রায় পঞ্চাশজন খাজা সাহেবের দলের লোক নমিনেশন পেয়ে গেল। আবার কেন্দ্রীয় লীগে খাজা সাহেবের সমর্থক বেশি ছিলেন। লিয়াকত আলী খান, খালিকুজ্জামান, হোসেন ইমাম, চুন্দ্রিগড় সাহেব সকলেই শহীদ সাহেবকে মনে মনে ভয় করতেন। কারণ সকল বিষয়েই শহীদ সাহেব এদের থেকে উপযুক্ত ছিলেন। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড প্রায় ত্রিশজনের নমিনেশন পাল্টিয়ে দিলেন। এদের মধ্যে দুই একজন শহীদ সাহেবেরও সমর্থক ছিলেন, একথা অস্বীকার করা যায় না।