কাউন্সিল সভা যখন শুরু হল, মওলানা আকরম খা সাহেব কিছু সময় বক্তৃতা করলেন। তারপরই আবুল হাশিম সাহেব সেক্রেটারি হিসাবে বক্তৃতা দিতে উঠলেন। কিছু সময় বক্তৃতা দেওয়ার পরই নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলের কয়েকজন তার বক্তৃতার সময় গোলমাল করতে আরম্ভ করলেন। আমরাও তার প্রতিবাদ করলাম, সাথে সাথে গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। সমস্ত যুবক সদস্যই ছিল শহীদ সাহেবের দলে, আমাদের সাথে টিকবে কেমন করে। নাজিমুদ্দীন সাহেবকে কেউ কিছু বলল না। তবে তাঁর দলের সকলেরই কিছু কিছু মারপিট কপালে জুটেছিল। আমি ও আমার বন্ধু আজিজ সাহেব দেখলাম, শাহ আজিজুর রহমান সাহেব ছাত্রলীগের ফাইল নিয়ে নাজিমুদ্দীন সাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ও আজিজ পরামর্শ করছি শাহ সাহেবের কাছ থেকে এই খাতাগুলি কেড়ে নিতে হবে, আমাদের ছাত্রলীগের কাজে সাহায্য হবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব যখন চলে যাচ্ছিলেন, শাহ সাহেও রওয়ানা করলেন, আজিজ তাকে ধরে ফেলল। আমি খাতাগুলি কেড়ে নিয়ে বললাম, কথা বলবেন না, চলে যাবেন। আজকাল যখন শাহ সাহেবের সাথে কথা হয় ও দেখা হয় তখন সেই কথা মনে করে হাসাহাসি করি। শাহ সাহেব ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলিতে আওয়ামী লীগ পার্টির নেতা এবং বিরোধী দলের ডেপুটি লিডার হন। তাঁর সাথে আমার মতবিরোধ ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’ জারি হওয়া পর্যন্ত চলে।
মওলানা সাহেব পরের দিন পর্যন্ত সভা মুলতবি রাখলেন এবং দশটায় ভোটগ্রহণ শুরু হবে বলে ঘোষণা করলেন। ব্যালট করা হল। পাশের রুমে বাক্স রাখা হল। একজন পাঁচটা করে ভোট দিতে পারবে। আমি ভিতরের গেটে দাঁড়িয়ে ক্যানভাস করছিলাম, মওলানা সাহেবের কাছে কে যেন নালিশ করেছে। তিনি আমাকে বললেন, “তুমি ওখানে কি করছ ছোকরা?” আমি বললাম, “আমিও একজন সদস্য, ছোকরা না।” মওলানা সাহেব হেসে চলে গেলেন।
সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোট গণনা হয়ে গেল। শহীদ সাহেবের দলের পাঁচজনই জিতলেন। আমি ফুলের মালা জোগাড় করেই রেখেছিলাম, আরও অনেকেই মালা জোগাড় করে রেখেছিল। আমি যখন শহীদ সাহেবের গলায় মালা দিলাম, শহীদ সাহেব আমাকে আদর করে বললেন, তুমি ঠিক বলেছিলে। লাল মিয়া সাহেবকে নিয়ে আমাদের ভয় ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেককে অনুরোধ করেছিলাম, তাঁকে একটা ভোট দিতে। ফরিদপুর জেলার মাত্র সামান্য কয়েকটা ভোটই শহীদ সাহেবের দল পেয়েছিল। লাল মিয়া সাহেব, আমি ও আরও কয়েকজন ভোট দিয়েছি, আর সকল ভোটই তমিজুদ্দিন সাহেব, মোহন মিয়া ও সালাম সাহেবের নেতৃত্বে নাজিমুদ্দীন সাহেবের দল পেয়েছিল। লাল মিয়া সাহেবের জন্য দুই চারটা ভোট ফরিদপুর থেকে আমি জোগাড় করেছিলাম। লাল মিয়া সাহেব মোহন মিয়া সাহেবের সহোদর ভাই হলেও তিনি লাল মিয়ার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
অন্য কথায় যাওয়ার পূর্বে আর একটা কথা না বললে অন্যায় হবে। লাল মিয়া সাহেব পার্লামেন্টারি বোর্ডের মেম্বার হওয়ার পরে ফরিদপুরের সদস্য নমিনেশনের সময় ভাইয়ের পক্ষ অবলম্বন করেন। আমাদের দলের লোককে নমিনেশন দিতে রাজি হন নাই। ফরিদপুরের ছয়টা সিটের মধ্যে অনেক ঝগড়া করে মাত্র দুইটা সিট আমরা পেয়েছিলাম। একটা রাজবাড়ীর খান বাহাদুর ইউসুফ হোসেন চৌধুরীর সিট, আরেকটা মাদারীপুরের ইস্কান্দার আলী সাহেবের। মোহন মিয়া নির্বাচনে দত্তপাড়ার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী ওরফে বাদশা মিয়ার কাছে পরাজিত হন। বাদশা মিয়া ফল ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই ঘোষণা করলেন, আমার জয় মুসলিম লীগের জয় ও পাকিস্তানের জয়। লাল মিয়া ও মোহন মিয়া সকল সময়ই ভিন্ন দলে থাকতেন। প্রথমে লাল মিয়া সাহেব কংগ্রেস করতেন, মোহন মিয়া সাহেব মুসলিম লীগ করতেন। আবার মুসলিম লীগে যখন যোগদান করলেন, এক ভাই রইলেন শহীদ সাহেবের দলে, আরেক ভাই খাজা নাজিমুদ্দীনের দলে। আবার পাকিস্তান আমলে আইয়ুবের মার্শাল ল আসলে, এক ভাই আইয়ুব খান সাহেবের দলে, আর এক ভাই বিরোধী দলে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের ক্ষমতা ঠিকই থাকে। এই অপূর্ব খেলা আমরা দেখেছি জীবনভর! রাতেরবেলা দুই ভাই এক, নিজেদের স্বার্থের বেলায় মুহূর্তের মধ্যেই এক হয়ে যান।
১৪.
এই সময় আমাদের উপর মুসলিম লীগ থেকে হুকুম হল, জেলায় জেলায় চলে গিয়ে ইলেকশন অফিসের ভার নিতে। প্রত্যেক জেলায় ও মহকুমায় ইলেকশন অফিস ও কর্মী শিবির ভোলা হবে। জেলায় জেলায় ভাল ভাল কর্মীদের কর্মী শিবিরের চার্জ নিতে হবে। আমার কয়েকটা জেলার কথা মনে আছে। কারুন্দিন সাহেব ঢাকা জেলা, শামসুল হক সাহেব ময়মনসিংহ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ কুমিল্লা, একরামুল হক খুলনা এবং আমাকে ফরিদপুর জেলার ভার দেওয়া হয়েছিল। আমরা রওয়ানা হয়ে চলে এলাম সাইকেল, মাইক্রোফোন, হর্ন, কাগজপত্র নিয়ে। জেলা লীগ আমাদের সাথে সহযোগিতা করবে। আমরা প্রত্যেক মহকুমায় ও থানায় একটা করে কর্মী শিবির খুলব। আমাকে কলেজ ছেড়ে চলে আসতে হল ফরিদপুরে। ফরিদপুর শহরে মিটিং করতে এসেছি মাঝে মাঝে, কিন্তু কোনোদিন থাকি নাই। আমাকে ভার দেওয়ার জন্য মোহন মিয়া সাহেব ক্ষেপে যান। সকলকে সাবধান করে দেন, কেউ যেন আমাকে বাড়ি ভাড়া না দেয়। তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি, কিন্তু আমাকে চান না। আমি আবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্ল জালালউদ্দিনকে সকল কিছু দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। হামিদ ও জালাল ফরিদপুর কলেজে পড়ত, তাদেরও লেখাপড়া ছেড়ে আসতে হল। শহরের উপরে কেউই বাড়ি দিতে রাজি হল না। আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় শহর থেকে একটু দূরে তার একটা দোতলা বাড়ি ছিল, ভাড়া দিতে রাজি হল। বাধ্য হয়ে আমাকে সেখানে থাকতে হল। সেখানে আমরা অফিস খুললাম, কর্মীদের ট্রেনিং দেয়ার বন্দোবস্ত হল। সমস্ত জেলায় ঘুরতে শুরু করলাম। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ীতে অফিস খুলে দিলাম, কাজ শুরু হল। থানায় থানায়ও অফিস করলাম। এই সময় মাঝে মাঝে আমাকে কলকাতায় যেতে হত। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব কিছুদিন পূর্বে একবার গোপালগঞ্জ এসেছিলেন। বিরাট সভা করে গিয়েছিলেন। এই সময় সালাম সাহেবের দল শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবকে সংবর্ধনা দিতে রাজি হয় নাই, কারণ আমার অনুরোধে তারা এসেছিলেন। তাঁর দলবল প্রশ্ন করল, আমি মুসলিম লীগের একজন সদস্য মাত্র। অফিসিয়াল লীগের কেউই নই, এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে গেল গোপালগঞ্জে। শহীদ সাহেব আসবার মাত্র দুই দিন পূর্বে আমি বললাম, আমি গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগের জন্মদাতা। শহীদ সাহেব আসবেন, তাকে সংবর্ধনা দিব, যদি কেউ পারে যেন মোকাবেলা করে। আমি রাতে লোক পাঠিয়ে দিলাম। যেদিন দুপুরে শহীদ সাহেব আসবেন সেদিন সকালে কয়েক হাজার লোক সড়কি, বল্লম, দেশী অস্ত্র নিয়ে হাজির হল। সালাম সাহেবের লোকজনও এসেছিল। তিনি বাধা দেবার চেষ্টা করেন নাই। তবে, শহীদ সাহেব, হাশিম সাহেব ও লাল মিয়া সাহেবের বক্তৃতা হয়ে গেলে সালাম সাহেব যখন বক্তৃতা করতে উঠলেন তখন সালাম সাহেব জিন্দাবাদ’ দিলেই আমাদের লোকেরা মুর্দাবাদ’ দিয়ে উঠল। দুই পক্ষে গোলমাল শুরু হল। শেষ পর্যন্ত সালাম সাহেবের লোকেরা চলে গেল। আমাদের লোকেরা তাদের পিছে ধাওয়া করল। শহীদ সাহেব মিটিং ছেড়ে দুই পক্ষের ভিতর ঢুকে পড়লেন। তখন দুই পক্ষের হাতেই ঢাল, তলোয়ার রয়েছে। কতজন খুন হবে ঠিক নাই। শহীদ সাহেব এইভাবে খালি হাতে দাঙ্গাকারী দুই দলের মধ্যে চলে আসতে পারেন দেখে সকলে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। হাশিম সাহেব পূর্বেই আমার বাড়িতে চলে গেছেন। এই ঘটনার জন্য শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব সালাম সাহেবের উপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন।