মওলানা আকরম খাঁ সাহেব একটা আপোস করার চেষ্টা করলেন। মওলানা সাহেবের বাড়িতে শহীদ সাহেব ও মওলানা সাহেবের আলোচনা হল। শহীদ সাহেব নরম হয়ে গেছেন দেখলাম। তিনি বললেন, “এখন পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম, গোলমাল করে কি হবে, একটা আপোস হওয়াই ভাল। আমরা বললাম, চারজনের মধ্যে দুইজনই তো নাজিমুদ্দীন সাহেবের ছিলেন, তিনি নিজে ও মওলানা সাহেব। কেন আর দুইজনের মধ্যে একজন আপনার গ্রুপ থেকে দিলেন না, আপনাকে না দিত। আমরা বললাম, কিছুতেই হবে না।
দিন তারিখ আমার মনে নাই, তবে ঘটনাটা মনে আছে। বিকালে কলকাতা এ্যাসেম্বলি পার্টি রুমে এমএলএ, এমএলসি ও লীগ নেতাদের বৈঠক হবে, সেখানে আপোস হবে। আমরাও খবর পেলাম। বেকার হোস্টেল ও অন্যান্য হোস্টেলে খবর দিয়ে দুই তিনশত ছাত্র নিয়ে আমিও উপস্থিত হলাম। দরজা বন্ধ করে সভা হচ্ছিল। আমি দরজায় যেয়ে বললাম, “আমাদের কথা আছে, গুনতে হবে। শেষ পর্যন্ত নেতারা রাজি হলেন। দরজাগুলি খুলে দিলেন। ছাত্ররা ভিতরে বসল। আমিই প্রথম বক্তা, প্রায় আধা ঘন্টা বক্তৃতা করলাম এবং শহীদ সাহেবকে বললাম, “আপোস করার কোনো অধিকার আপনার নাই। আমরা বাজাদের সাথে আপোস করব না। কারণ, ১৯৪২ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজের ভাইকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আবার তার বংশের থেকে এগারজনকে এমএলএ বানিয়েছিলেন। এদেশে তারা ছাড়া আর লোক ছিল না? মুসলিম লীগে কোটারি করতে আমরা দিব না। আমরাই হক সাহেবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, দরকার হয় আপনাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করব।” শহীদ সাহেবকে বাধ্য করে সভা থেকে উঠিয়ে নিয়ে চলে এসেছিলাম। আমার পরে ফজলুল কাদের চৌধুরী ও ফরিদপুরের লাল মিয়া সাহেবও আমাকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। রাতে আমাদের সভা হল। আমরা প্রায় রাতভরই শহীদ সাহেবের সাথে রইলাম। শহীদ সাহেবের কাছে জনাব নাজিমুদ্দীন সাহেব জানতে চেয়েছেন, আপোস হবে কি না তাকে জানাতে। তিনি শহীদ সাহেবকে ফোনের মাধ্যমে অনুরোধ করলেন, আমরা বুঝতে পারলাম। শহীদ সাহেব বললেন, “যা হয় আগামীকাল সকাল নয়টার মধ্যে জানিয়ে দিব।” আমাদের সকাল আটটার মধ্যে তার বাসায় আসতে বলে দিলেন। এই সময় নূরুদ্দিন, একরাম, নূরুল আলম, শরফুদ্দিন, জহির, আমরা প্রায় সকল সময় একসাথেই থাকি; ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেবও দলবল নিয়ে কলকাতায়ই ছিলেন। চট্টগ্রামের ছাত্রদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।
আমরা সকালে শহীদ সাহেবের বাড়িতে যথাসময়ে হাজির হলাম। তিনি রাতে অনেকের সাথে আলাপ করেছিলেন। তিনি আমাদের নিয়ে বসলেন, আমি তার কাছেই বসলাম। শহীদ সাহেব বললেন, “বুঝতে পারছি না তোমরা পাঁচটা সিটই দখল করতে পারবে কি না?” আমি বললাম, “স্যার, বিশ্বাস করেন আমরা নিশ্চয়ই জিতব, খোদার মর্জি থাকলে আমাদের পরাজিত হবার কোনো কারণ নাই।” আমি টেলিফোন তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, “বলে দেন খাজা সাহেবকে ইলেকশন হবে।” শহীদ সাহেব নাজিমুদ্দীন সাহেবকে টেলিফোন করে বললেন, “ইলেকশনই হবে। যাই হোক না কেন, ইলেকশনের মাধ্যমেই হবে। সকলেই তো মুসলিম লীগার, আমরা কেন উপরের থেকে চাপাতে যাব।” নাজিমুদ্দীন সাহেব কি যেন বললেন। শহীদ সাহেব বললেন, “আর হয় না। আপনারা ভাল ব্যবহার করেন নাই।”
আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম। রাতে জেলা প্রতিনিধিরা লীগ অফিসে আসলেন। একজনের কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে, তিনি হলেন নোয়াখালী জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি মুজিবুর রহমান মোক্তার সাহেব। তিনি জেলার নেতাদের কাছে একটা চমৎকার বক্তৃতা করেন। সমস্ত নোয়াখালী জেলা শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিল।
হাশিম সাহেবের নেতৃত্বে আমাদের অফিস ভালভাবে চলছিল। আমরা শিয়ালদহ ও হাওড়ায় লোক রাখলাম—কাউন্সিলারদের অভ্যর্থনার জন্য, থাকার জায়গারও বন্দোবস্ত করলাম। ছাত্রকর্মীরা কলেজ হোস্টেল ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে, যার যার জেলার কাউন্সিলারদের সাথে দেখা করার জন্য। দুই দিন পর্যন্ত রাতদিন ভীষণভাবে কাজ চলল। মওলানা রাগীব আহসান ও জনাব ওসমান সাহেব ছিলেন কলকাতা মুসলিম লীগের নেতা। কলকাতা মুসলিম লীগের সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত। তারাও গাড়ি ও কর্মী নিয়ে প্রচারে নেমে পড়ল। সভার দিন দেখা গেল, শত শত কর্মী হাজির হয়ে গেছে। আমরা যারা কাউন্সিলের সভ্য তারা হলের ভিতরে চলে গেলাম, আর কর্মীরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ক্যানভাস করতে লাগল। মাঝে মাঝে শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’, আবুল হাশিম জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছিল।
শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব পরামর্শ করে পাঁচজনের নাম ঠিক করলেন: ১. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ২. আবুল হাশিম, ৩. মওলানা রাগীব আহসান, ৪, আহমদ হোসেন এবং ৫. লাল মিয়া আমাদের পক্ষের, অন্য পক্ষ থেকে নাজিমুদ্দীন সাহেবও পাঁচজনের নাম দিলেন। এই সময় ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য হবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন ও ভীষণ ক্যানভাস শুরু করেন। আমিও তার জন্য তদ্বির করেছিলাম। শহীদ সাহেবও প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। লাল মিয়াকে বাদ দিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে নেওয়া হবে, তখনও ফাইনাল হয় নাই। এই অবস্থায় রাতে ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব নাজিমুদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করলেন এবং তাকে নমিনেশন দিলে তিনি চট্টগ্রাম গ্রুপ নিয়ে তার দলে যোগদান করবেন বলে প্রস্তাব দিলেন। শহীদ সাহেব রাতেই খবর পেলেন এবং বললেন, “কিছুতেই ওকে নমিনেশন দেওয়া হবে না, কারণ এই বয়সেই ওর এত লোভ।” ওদিকে নাজিমুদ্দীন সাহেবও তাকে তার দল থেকে নমিনেশন দিতে রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত চৌধুরী সাহেব শহীদ সাহেবের দলকেই ভোট দিলেন। তাঁর দলের সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত। এম, এ, আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, আজিজুর রহমান চৌধুরী সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। চৌধুরী সাহেবের এই ব্যবহারে তারাও কিছুটা মনোন্নই হয়েছিলেন। এরা সবাই ছিলেন আমার ব্যক্তিগত বন্ধু।