আমরা দুইজন একদিন সময় ঠিক করে তার সাথে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে ভাল ভাল লেখার হাত আছে, যারা সামান্য হাত খরচ পেলেই কাজ করবে। অনেককে কিছু না দিলেও চলবে। আরও দু’একবার দেখা করার পরে শহীদ সাহেব রাজি হলেন।
মুসলিম লীগ অফিসের নিচের তলায় অনেক খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হল। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারী করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সাহেবই কাগজের লেখাপড়ার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসাবে তাঁর যথেষ্ট নাম ছিল। ব্যবহারও অমায়িক ছিল। সমস্ত বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিল। তারা কাগজ চালাতে শুরু করল। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল মিল্লাত’।
হাশিম সাহেবের গ্রুপকে অন্য দল কমিউনিস্ট বলতে শুরু করল, কিন্তু হাশিম সাহেব ছিলেন মওলানা আজাদ সোবহানীর একজন ভক্ত। তিনি বিখ্যাত ফিলোসফার ছিলেন। মওলানা আজাদ সোবহানী সাহেবকে হাশিম সাহেব আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন কলকাতায়। আমাদের নিয়ে তিনি ক্লাস করেছিলেন। আমার সহকর্মীরা অধিক রাত পর্যন্ত তার আলোচনা শুনতেন। আমার পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কষ্টকর। কিছু সময় যোগদান করেই ভাগতাম। আমি আমার বন্ধুদের বলতাম, “তোমরা পণ্ডিত হও, আমার অনেক কাজ। আগে পাকিস্তান আনতে দাও, তারপরে বসে বসে আলোচনা করা যাবে। হাশিম সাহেব তখন চোখে খুব কম দেখতেন বলে রক্ষা। আমি পিছন থেকে ভাগতাম, তিনি কিন্তু বুঝতে পারতেন। পরের দিন দেখা করতে গেলেই জিজ্ঞাসা করতেন, “কি হে, তুমি তো গতরাতে চলে গিয়েছিলে।” আমি উত্তর দিতাম, “কি করব, অনেক কাজ ছিল।” কাজ তো থাকতই ছাত্রদের সাথে, দল তো ঠিক রাখতে হবে।
১৩.
ইলেকশনের দিন ঘোষণা হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন হবে। কাউন্সিল সভা ডাকা হল, কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডে নয়জন সদস্য থাকবে। তার মধ্যে দুইজন এক্স-অফিসিও, আর মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে একজন, আর একজন এমএলএদের মধ্য থেকে, বাকি পাঁচজনকে কাউন্সিল নির্বাচিত করবে। পূর্বের থেকেই দলে দুই গ্রুপ হয়ে গেছে। তথাপি পাকিস্তান ইস্যুর ওপর নির্বাচন, এ সময় গোলমাল না হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। আমরা ভালভাবেই বুঝতাম, চারজনের মধ্যে একজন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি যথা মওলানা আকরম খাঁ সাহেব, একজন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা হিসাবে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব, আর পার্লামেন্টারি পার্টি একজন প্রতিনিধি দিবেন এবং একজন আপার হাউজের মুসলিম লীগ গ্রুপ থেকে নির্বাচিত হবেন। নাজিমুদ্দীন সাহেব পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ছিলেন, এমএলএ ও এমএলসিরা তারই ভক্ত বেশি ছিল। শহীদ সাহেব ডেপুটি লিডার হওয়া। সত্ত্বেও তাঁকে প্রতিনিধি না করে নাজিমুদ্দীন সাহেব ফজলুর রহমান সাহেবকে পাঠালেন। শহীদ সাহেবকে বললেন, আপনাকে নির্বাচিত করে লাভ কি? আপনি তো কাউন্সিল থেকে ইলেকশন করে বোর্ডের মেম্বার হতে পারবেন। ফজলুর রহমান সাহেব পারবেন না, তাই তাঁকেই সদস্য করলাম। আপার হাউস মুসলিম লীগ গ্রুপ থেকে বোধহয় নূরুল আমিন সাহেবকে নিলেন। এইভাবে নয়জনের মধ্যে চারজন তার দলেরই হয়ে গেল। যেভাবেই হোক আর একজনকে তিনি ইলেকশনের মাধ্যমে পার করে নিতে পারবেন। এতেই গোলমাল শুরু হয়ে গেল। আমরা প্রতিবাদ করলাম এবং বললাম, শহীদ সাহেবকে এমএলএদের পক্ষ থেকে কেন নেওয়া হবে না? তাকে অপমান করা হয়েছে। কারণ, তিনি ডেপুটি লিডার মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির। এটা একটা ষড়যন্ত্র। শহীদ সাহেব আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন, “ঠিক আছে, এতে কি হবে!” আমরা বললাম, “আপনি আর উদারতা দেখাবেন না। নাজিমুদ্দীন সাহেবের মনে রাখা উচিত ছিল যে, তিনি আজ মুসলিম লীগ পার্টির নেতা ও এমএলএ হয়েছেন একমাত্র আপনার জন্য। পটুয়াখালীতে শেরে বাংলা তাঁকে পরাজিত করে রাজনীতি থেকে বিদায় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কোনো জেলা থেকেই তিনি হক সাহেবের সাথে ইলেকশন করে জিততে পারতেন না, যদি না আপনি তাঁকে আপনার একটা সিট থেকে পদত্যাগ করে পাস করিয়ে নিতেন। তাও আবার কলকাতা হলে আপনিও পারতেন না।”
শহীদ সাহেব ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কলকাতা থেকে দুইটা সিটে এমএলএ হন। নাজিমুদ্দীন সাহেব পটুয়াখালী থেকে পরাজিত হয়ে ফিরে আসলেন। তাঁর রাজনীতি থেকে সরে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। শহীদ সাহেব হক সাহেবকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললেন, আমি নাজিমুদ্দীন সাহেবকে কলকাতা থেকে বাই ইলেকশনে পাস করিয়ে নেব। যদি হক সাহেব পারেন, তাঁর প্রতিনিধি দিয়ে মোকাবেলা করাতে পারেন। হক সাহেবও লোক দাঁড় করিয়েছিলেন নাজিমুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে। নাজিমুদ্দীন সাহেবই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলেন, শহীদ সাহেবের দয়ায়। সেই নাজিমুদ্দীন সাহেব শহীদ সাহেবকে অপমানই করলেন। যাহোক, আমাদের পক্ষ থেকে পাঁচজনই আমরা কাউন্সিলে দাঁড় করাব, নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলের কাউকেও হতে দেব না। কারণ, আমাদের ভরসা ছিল কাউন্সিলে শহীদ সাহেব সংখ্যাগুরু।