এই সময়কার একজন ছাত্রনেতার নাম উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে; কারণ, তিনি কোনো গ্রুপে ছিলেন না এবং অন্যায় সহ্য করতেন না। সত্যবাদী বলে সকলে তাকে শ্রদ্ধা করতেন। নেতাদের সকলেই তাঁকে স্নেহ করতেন। তার নাম এখন সকলেই জানেন, জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী বার এট ল’। এখন ঢাকা হাইকোর্টের জজ সাহেব। তিনি দুই গ্রুপের মধ্যে আপোস করতে চেষ্টা করতেন। শহীদ সাহেবও চৌধুরী সাহেবের কথার যথেষ্ট দাম দিতেন। জনাব আবদুল হাকিম এখন হাইকোর্টের জজ হয়েছেন। তিনি টেইলর হোস্টেলের সহ-সভাপতি ছিলেন, ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। জজ মকসুমুল হাকিম সাহেব ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন না। বেকার হোস্টেলের প্রিমিয়ার হয়েছিলেন, ভাল ছাত্র ছিলেন, লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
এই সময় শহীদ নজীর আহমেদ নিহত হবার পরে ঢাকার ছাত্রদের নেতৃত্ব দিতেন জনাব শামসুল হক সাহেব, শামসুদ্দিন আহমেদ, নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং আরও অনেকে। এরা সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। পরে হাশিম সাহেবেরও ভক্ত হন। এরা সকলেই ছাত্র আন্দোলনের সাথে সাথে মুসলিম লীগ সংগঠনকে কোটারির হাত থেকে বাঁচার জন্য মুসলিম লীগের কাজে যোগদান করেছিলেন। ঢাকায় প্রাদেশিক লীগের একটা আঞ্চলিক শাখা অফিস হাশিম সাহেব খোলেন ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে। কমিউনিস্ট পার্টির মত হোলটাইম ওয়ার্কার হিসাবে এরা অনেকেই যোগদান করেন। শামসুল হক সাহেব এই অফিসের ভার নেন। আমরাও কলকাতা অফিসের হোলটাইম ওয়ার্কার হয়ে যাই। যদিও হোস্টেলে আমার রুম থাকত, তবু আমরা প্রায়ই লীগ অফিসে কাটাতাম। রাতে একটু লেখাপড়া করতাম। সময় সময় কলেজে পার্সেন্টেজ রাখতাম। পাকিস্তান না আনতে পারলে লেখাপড়া শিখে কি করব? আমাদের অনেকের মধ্যে এই মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল।
কলকাতার আহমেদ আলী পার্কে মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভা হবে, তখন দুই পক্ষের মোকাবেলা হবে। আমরা হাশিম সাহেবকে জেনারেল সেক্রেটারি করব এবং ম্যানিফেস্টো পাস করাব। অন্য দল হাশিম সাহেবকে সেক্রেটারি হতে দেবে না। নেতাদের মধ্যে অনেকেই শহীদ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। তারা শহীদ সাহেবকে সমর্থন করতেন কিন্তু হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। শেষ পর্যন্ত মওলানা আকরম খাঁ সাহেব, শহীদ সাহেব ও খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব বসে একটা প্যানেল ঠিক করলেন। হাশিম সাহেবই সেক্রেটারি থাকবেন তবে ম্যানিফেস্টো এবার পাস হবে না। একটা সাব-কমিটি করা হবে, তাদের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করে ম্যানিফেস্টো ঠিক হবে। আমার মনে হয়, ম্যানিফেস্টো সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছিল। আর কি কি সিদ্ধান্ত হয়েছিল আমার ঠিক মনে নাই। যাহোক, শহীদ সাহেব বললেন, “এখন গোলমাল করার সময় নয়। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। নিজেদের মধ্যে গোলমাল হলে পাকিস্তান দাবির সংগ্রাম পিছিয়ে যাবে।”
০৯.
এই সময় বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের পতন হয়। গভর্নর শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নেন। শহীদ সাহেব দেখলেন যুদ্ধের সময় অধিক লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা কালো বাজারে কাপড় বিক্রি করার জন্য গুদামজাত করতে শুরু করছে। একদিকে খাদ্য সমস্যা ভয়াবহ, শহীদ সাহেব রাতদিন পরিশ্রম করছেন, আর একদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করেছে : শহীদ সাহেব সমস্ত কর্মচারীদের হুকুম দিলেন, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের আড্ডাখানা বড়বাজার ঘেরাও করতে। সমস্ত বড়বাজার ঘেরাও করা হল। হাজার হাজার গজ কাপড় ধরা পড়ল, এমনকি দালানগুলির নিচেও এক একটা গুদাম করে রেখেছিল তাও বাদ গেল না। এমনি করে সমস্ত শহরে চাউল গুদামজাতকারীদের ধরবার জন্য একইভাবে তল্লাশি শুরু করলেন। মাড়োয়ারিরাও কম পাত্র ছিল না। কয়েক লক্ষ টাকা তুলে লীগ মন্ত্রিসভাকে খতম করার জন্য কয়েকজন এমএলএকে কিনে ফেলল। ফলে এক ভোটে লীগ মন্ত্রিত্বকে পরাজয়বরণ করতে হল। যদিও এটা অনাস্থা প্রস্তাব ছিল না। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব চ্যালেঞ্জ দিলেন এই কথা বলে যে, আগামীকাল আমি আস্থা ভোট নেব, যদি আস্থা ভোট না পাই তবে পদত্যাগ করব। স্পিকার ছিলেন নওশের আলী সাহেব। পরের দিন তিনি এ ব্যাপারে কুলিং দিলেন, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে, আর আস্থা ভোটের দরকার নাই।
আমি কিছু সংখ্যক ছাত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। খবর যখন রটে গেল লীগ মন্ত্রিত্ব নাই, তখন দেখি টুপি ও পাগড়ি পরা মাড়োয়ারিরা বাজি পোড়াতে শুরু করেছে এবং হৈচৈ করতে আরম্ভ করেছে। সহ্য করতে না পেরে, আরও অনেক কর্মী ছিল, মাড়োয়ারিদের খুব মারপিট করলাম, ওরা ভাগতে শুরু করল। জনাব মোহাম্মদ আলী বাইরে এসে আমাকে ধরে ফেললেন এবং সকলকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। হিন্দু নেতারাও বাইরে এসে প্রতিবাদ করল। যাহোক, কিছু সময় পর সব শান্ত হয়ে গেল, আমরা ফিরে এলাম। এই সময় বোধহয় দেড় বছরের মত মুসলিম লীগ শাসন করে, যদিও গভর্নরই সর্বময় ক্ষমতার মালিক ছিলেন। আমি নিজে জানি, শহীদ সাহেব কলকাতা ক্লাবের সদস্য ছিলেন। রাতে একবার দুই এক ঘন্টার জন্য কলকাতায় থাকলে ক্লাবে যেতেন, কিন্তু যেদিন তিনি সিভিল সাপ্লাইয়ের মন্ত্রী হন, তারপর থেকে এক মুহূর্তও সময় পান নাই কলকাতা ক্লাবে যেতে। রাত বারটা পর্যন্ত তিনি অফিস করতেন। আমি ও নুরুদ্দিন রাত বারটার পরেই শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করতে এবং রাজনীতি সম্বন্ধে আলোচনা করতে প্রায়ই তার বাড়িতে যেতাম। কারণ, দিনেরবেলায় তিনি সময় পেতেন না। তিনি আমাদের এই সময়ের কথা বলে দিয়েছিলেন।