চট্টগ্রামে টেলিগ্রাম করলাম কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগের প্রতিনিধি পাঠাতে। লোক পাঠালাম সমস্ত জেলায়। নূরুদ্দিন, একরাম, শরফুদ্দিন, খন্দকার নূরুল আলম, আমি ও আমার সহকর্মীরা রাতদিন কাজ করতে আরম্ভ করলাম। আমাদের অর্থের খুব অভাব, কারণ হাশিম সাহেবের টাকা পয়সা ছিল না। শহীদ সাহেব আমাদের সামান্য সাহায্য করেছিলেন। আমরা নিজেরা চাঁদা তুললাম এবং দলবল নিয়ে কুষ্টিয়া পৌঁছালাম। কিউ. জে. আজমিরী ও হামিদ আলী নামে দুইজন ভাল কর্মী ছিল। আজমিরী ভীষণ রাগী ছিল। কথায় কথায় মারপিট করে ফেলত, শক্তিও ছিল, সাহসও ছিল। আজমিরী হাশিম সাহেবের আত্মীয়। ফরিদপুর কুষ্টিয়ার কাছে। ফরিদপুরে ছাত্রদের দুই ভাগ ছিল। এক ভাগ আমার সাথে আর একভাগ মোহন মিয়া সাহেবের সমর্থক। মোহন মিয়া সাহেব আনোয়ার সাহেবকে সমর্থন করতেন। কুষ্টিয়ায় যখন আমরা পৌঁছালাম তখন দেখা গেল যত কাউন্সিলার এসেছে তার মধ্যে শতকরা সত্তরজন আমাদের সমর্থক। দুই দলের নেতৃবৃন্দের এক জায়গায় বসা হল, উদ্দেশ্য আপোস করা যায় কি না? বগুড়ার ফজলুল বারীকে (এখন পূর্ব বাংলার গভর্নর মোনেম খান সাহেবের মন্ত্রী হয়েছেন) সভাপতি করে আলোচনা চলল। কথায় কথায় ঝগড়া, তারপর মারামারি হল, শাহ সাহেব অনেক গুণ্ডা জোগাড় করে এনেছিলেন। আমরা বলেছিলাম, যদি গুণ্ডামি করা হয়, তবে কলকাতায় তাকে থাকতে হবে না। শেষ পর্যন্ত আপোস হল না। কুমিল্লার ছাত্রলীগ নেতারা আমাদের সাথেই ছিলেন। সকালে শোনা গেল তারা আনোয়ার সাহেবের দলের সাথে মিশে গেছেন, কারণ তাদের তিনটা পদ দেয়া হয়েছে। রফিকুল হোসেনকে আমাদের দলই কলকাতা থেকে কাউন্সিলার করে। তিনি আমাদের সকল পরামর্শ সভায়ও যোগদান করতেন। শফিকুল ইসলামও বেকার হোস্টেলে থাকত। আমাদের সাথেই আনোয়ার সাহেবের দলের বিরুদ্ধে কাজ করত। আর আবদুল হাকিম সাহেব তো আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। তখন থেকেই একসাথে কাজ করেছি। সকালবেলা এরা দল ত্যাগ করল। তথাপি আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি। কোনো ভয় নাই, আনোয়ার সাহেবের দল পরাজিত হবেই।
সিনেমা হলে কাউন্সিল অধিবেশন হবে। জনাব হামুদুর রহমান সাহেব (এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি) সভাপতির আসন গ্রহণ করবেন। তিনি এডহক কমিটির সদস্য ছিলেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্রলীগ ফেডারেশনের পক্ষ হতে তিনি সভাপতিত্ব করবেন। এটা আমাদেরই দাবি ছিল। আমরা যখন হলে ঢুকলাম তখন দেখলাম অনেক বাইরের লোক হলে বসে আছে। আমরা সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। আমাদের পক্ষ থেকে একরামুল হক বৈধতার প্রশ্ন তুলল এবং দাবি করল, ‘সকল প্রতিনিধি, হল থেকে বের হয়ে যাবে, দুইটা গেট খোলা থাকবে, দুই পক্ষ থেকে দুইজন করে চারজন প্রতিনিধি প্রত্যেকের কার্ড পরীক্ষা করে হলে আসতে দিবে।’
এই সময় হলের উপর তলার বারান্দায় বাইরের ছাত্ররা অনেক এসেছে, তারা দর্শক। একজন ছাত্র, হাফপ্যান্ট পরা চিৎকার করে বলছে, “আমি জানি এরা অনেকেই ছাত্র না, বাইরের লোক। শাহ আজিজ দল বড় করবার জন্য এদের এনেছে।” পরে খবর নিয়ে জানলাম, ছেলেটির নাম কামারুজ্জামান (পরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলা পরিষদের সদস্য হয়েছিল)। জনাব হামুদুর রহমান সাহেব আমাদের কথা মানলেন না, তিনি সভার কাজ শুরু করে দিলেন। যেখানে বিশজন ছাত্রকে কো-অপ্ট করা হবে কনফারেন্স শুরু হবার সময়, সেখানে তিনি ভোটে দিয়ে দিলেন। আমরা বাইরের লোকদের বের করে দিতে অনুরোধ করতে থাকলাম। ভীষণ চিত্তার শুরু হল, আমরা দেখলাম মারপিট হবার সম্ভাবনা আছে। কয়েকজন বসে পরামর্শ করে আমাদের সমর্থকদের নিয়ে সভা ত্যাগ করলাম প্রতিবাদ করে। আমরা ইচ্ছা করলে আর একটা প্রতিষ্ঠান করতে পারতাম। প্রায় সমস্ত জেলায়ই আমাদের সমর্থক ছিল। তা করব না ঠিক করলাম, তবে কলকাতায় এদের কোন সভা করতে দেব না। কলকাতা মুসলিম ছাত্রলীগের নামেই আমরা কাজ করে যেতে লাগলাম। অল বেঙ্গল নেতাদের কোনো স্থান ছিল না।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আর কোন ইলেকশন এরা করে নাই। মুসলিম ছাত্রলীগ দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, একদল পরিচিত হত শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের দল বলে, আরেক দল পরিচিত হত খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব এবং মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের দল বলে। আমরা মওলানা আকরম খাঁ সাহেবকে সকলেই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার ছিল না।
এই সময় একটা আলোড়নের সৃষ্টি হল। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে মুসলিম লীগের একটা ড্রাফট ম্যানিফেস্টো বের করলেন। মুসলিম লীগ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং এর রাজনৈতিক দাবিও থাকবে, ভবিষ্যতে পাকিস্তান পেলে অর্থনৈতিক কাঠামো কি হবে তাও থাকতে হবে। জমিদারি প্রথা বিলোপসহ আরও অনেক কিছু এতে ছিল। ভীষণ হৈচৈ পড়ে গেল। আমরা যুবক, ছাত্র ও প্রগতিবাদীরা এটা নিয়ে ভীষণভাবে প্রপাগান্ডা শুরু করলাম। পাকিস্তান আমাদের আদায় করতে হবে এবং পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো কি হবে তার একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকা দরকার। হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা ক্লাস করতেন। ঢাকায় এসে কয়েকদিন থাকতেন এবং কর্মীদের নিয়ে আলোচনা সভা করতেন। কলকাতা লীগ অফিসে তিনি থাকতেন, ঢাকার লীগ অফিসেও তিনি থাকতেন! কর্মীদের সাথে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ রাখতেন। আমি তাঁর সাথে কয়েক জায়গায় সভা করতে গিয়েছি।