শাহ সাহেব চমৎকার বক্তৃতা করতে পারতেন। বগুড়ায় তাকে আমি প্রথম দেখি। আনোয়ার সাহেব কলকাতা ও ঢাকায় কনফারেন্স করতে সাহস না পেয়ে কুষ্টিয়ায় শাহ আজিজুর রহমানের নিজের জেলায় বার্ষিক প্রাদেশিক সম্মেলন ডাকলেন। এই সময় আনোয়ার সাহেব ও নূরুদ্দিনের দলের মধ্যে ভীষণ গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। আনোয়ার সাহেব আমার কাছে লোক পাঠালেন এবং অনুরোধ করলেন, তার সাথে এক হয়ে কাজ করতে। তিনি আমাকে পদের লোভও দেখালেন। আমি বললাম, আমার পদের দরকার নাই, তবে সবার সাথে আলোচনা করা দরকার। নূরুদ্দিন সাহেবের দলও আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালায়। একপক্ষ আমাকে নিতেই হবে, কারণ আমার এমন শক্তি কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও ছিল না যে ইলেকশনে কিছু করতে পারব। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছেন। জহির সাহেব ছাত্র আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামান না, মুসলিম লীগেরই কাজ করেন।
কলকাতায় যে সকল ছাত্র-কর্মী ছিল তারা প্রায়ই হাশিম সাহেবের কাছে যাওয়াআসা করে। তার কাছে যেয়ে ক্লাস করে, এইভাবে তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। যে সমস্ত নিঃস্বার্থ কর্মী সে সময় কাজ করত তাদের মধ্যে নূরুদ্দিন, বর্ধমানের খন্দকার নূরুল আলম ও শরফুদ্দিন, সিলেটের মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী, খুলনার একরামুল হক, চট্টগ্রামের মাহাবুব আলম, নূরুদ্দিনের চাচাতো ভাই এস. এ. সালেহ অন্যতম ছিল। শেষ পর্যন্ত এদের সাথেই আমার মিল হল, কারণ আমরা সকলেই শহীদ সাহেব ও আবুল হাশিম সাহেবের ভক্ত ছিলাম, আনোয়ার সাহেবের দল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। কিন্তু শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। শহীদ সাহেব অবস্থা বুঝে আমাদের দুই দলের নেতৃবৃন্দকে ডাকলেন একটা মিটমাট করাবার জন্য। শেষ পর্যন্ত মিটমাট হয় নাই। এই সময় শহীদ সাহেবের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটা পদ দিতে বলেন, আমি বললাম কখনোই হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভাল কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব-নিকাশও কোনোদিন দাখিল করে না। শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, “Who are you? You are nobody.” আমি বললাম “If I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you Sir. I will never come to you again.” এ কথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম। আমার সাথে সাথে নূরুদ্দিন, একরাম, নূরুল আলমও উঠে দাঁড়াল এবং শহীদ সাহেবের কথার প্রতিবাদ করল। বর্তমান বুলবুল একাডেমির১৩ সেক্রেটারি মাহমুদ নূরুল হুদা সাহেব শহীদ সাহেবের খুব ভক্ত ছিলেন। সকল সময় শহীদ সাহেবের কাছে থাকতেন। আমরা তাকে হুদা ভাই’ বলে ডাকতাম। হুদা ভাইয়ের ব্যবহার ছিল চমৎকার। কারও কোনো বিপদ হলে, আর খবর পৌঁছে দিলে যত রাতই হোক না কেন হাজির হতেন। হুদা ভাই ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন। আমি যখন বিখ্যাত ৪০ নম্বর থিয়েটার রোড থেকে রাগ হয়ে বেরিয়ে আসছিলাম শহীদ সাহেব হুদা ভাইকে বললেন, “ওকে ধরে আনন।” রাগে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। হুদা ভাই দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেললেন। শহীদ সাহেবও দোতালা থেকে আমাকে ডাকছেন ফিরে আসতে। আমাকে হুদা ভাই ধরে আনলেন। বন্ধুবান্ধবরা বলল, শহীদ সাহেব ডাকছেন, বেয়াদবি কর না, ফিরে এস।” উপরে এলাম। শহীদ সাহেব বললেন, “যাও তোমরা ইলেকশন কর, দেখ নিজেদের মধ্যে গোলমাল কর না।” আমাকে আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, “তুমি বোকা, আমি তো আর কাউকেই একথা বলি নাই, তোমাকে বেশি আদর ও স্নেহ করি বলে তোমাকেই বলেছি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি যে সত্যিই আমাকে ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত। যখনই তার কথা এই কারাগারে বসে ভাবি, সেকথা আজও মনে পড়ে। দীর্ঘ বিশ বৎসর পরেও একটুও এদিক ওদিক হয় নাই। সেইদিন থেকে আমার জীবনে প্রত্যেকটা দিনই তার স্নেহ পেয়েছি। এই দীর্ঘদিন আমাকে তার কাছ থেকে কেউই ছিনিয়ে নিতে পারে নাই এবং তাঁর স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই।
শহীদ সাহেবের বাড়িতে দুই দল বসেও যখন আপোস হল না, তখন ইলেকশনে লড়তে হবে। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ কর্মীদের সাহায্য নিয়ে দখল করতে সক্ষম হলেন। খান বাহাদুররা জেলা লীগ কনফারেন্সে পরাজিত হলেন। ১৯৪৩ সাল থেকে চট্টগ্রামের এই কর্মীদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, আজ পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব অটুট আছে। চট্টগ্রামের এম. এ. আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আজিজুর রহমান, ডা. সুলতান আহমেদ (এখন কুমিল্লায় আছেন), আবুল খায়ের চৌধুরী এবং আরও অনেকে ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অনেকেই ছিটকে পড়েছেন। আজিজ ও জহুর আজও সক্রিয় রাজনীতি করছেন। জহুর শ্রমিক আন্দোলন। করেন এবং সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি। এম. এ. আজিজ (এখন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক) পাকিস্তান হওয়ার পরে অনেকবার ও অনেক দিন জেলে কষ্ট ভোগ করেছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব তখন এদের নেতা ছিলেন। পরে তিনি মুসলিম লীগেই থেকে যান। আজিজ ও জহুর আওয়ামী লীগে চলে আসেন। চৌধুরী সাহেব খুবই স্বার্থপর হয়ে ওঠেন এবং একগুয়েমি করতেন, সেজন্য যারা তাঁকে চট্টগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, পরে তারা সকলেই তাঁকে ত্যাগ করেন।