পরের দিন সুস্থ বোধ করতে লাগলাম। কনফারেন্সও শেষ হয়ে যাবে। খলিল ভাই আমাদের সাথেই দুই দিন থাকবেন। আমাদের দিল্লির সকল কিছু ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। এই সময় আর একটা ঘটনা ঘটল। বরিশালের নূরুদ্দিন আহমেদের সাথে আনোয়ার সাহেবের ঝগড়া হয়েছে। নূরুদ্দিন রাগ করে আমাদের কাছে চলে এসেছে। তার টাকা পয়সাও আনোয়ার সাহেবের কাছে। তাকে কিছুই দেয় নাই, একদম খালি হাতে আমার ও মাখনের কাছে এসে হাজির। বলল, “না খেয়ে মরে যাব, দরকার হয় হেঁটে কলকাতা যাব, তবু ওর কাছে আর যাব না।” এই নূরুদ্দিন সাহেবকেই মাখন ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের ইলেকশনে জেনারেল সেক্রেটারি পদে পরাজিত করেছিল। নূরুদ্দিনকে ছাত্ররা ভালবাসত কিন্তু সে আনোয়ার সাহেবের দলে ছিল বলে তাকে পরাজিত হতে হয়েছিল। আইএ পড়লেও দলের নেতা আমিই ছিলাম। আমরা একই হোস্টেলে থাকতাম। বললাম, “ঠিক আছে তোমার ওর কাছে যাওয়া লাগবে না, যেভাবে হয় চলে যাবে।“ যদিও ওর জন্য টিকিট করার টাকা আমাদের কাছে নাই। তিন দিন থাকব ঠিক হল। খাবার খরচ বেশি, হোটেলে খেতে হয়। দুই দিনের মধ্যেই খলিল ভাইকে নিয়ে দিল্লির লালকেল্লা, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, কুতুব মিনার, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ, নতুন দিল্লি দেখে ফেললাম। কিছু টাকা খরচ হয়ে গেল। হিসাব করে দেখলাম, তিনজনের টিকিট করার টাকা আমাদের নাই। দুইখানা টিকিট করা যায়, কিন্তু না খেয়ে থাকতে হবে। খলিল ভাই একমাত্র বন্ধু, তবে তিনি তখনও ছাত্র তার কাছেও টাকা পয়সা নাই। যাহোক, আর দেরি না করে স্টেশনে এসে হাজির হলাম। তিনজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, একখানা টিকিট করব এবং কোনো সার্ভেন্ট’ ক্লাসে উঠে পড়ব। ধরা যদি পড়ি, হাওড়ায় একটা বন্দোবস্ত করা যাবে।
প্রথম শ্রেণীর প্যাসেঞ্জারদের গাড়ির সাথেই চাকরদের জন্য একটা করে ছোট্ট গাড়ি থাকে। সাহেবদের কাজকর্ম করে এখানেই এসে থাকে চাকররা। দিল্লি যাওয়ার সময় আমরা ইন্টারক্লাসে যাই। এখন টাকা ফুরিয়ে গেছে, কি করি? একখানা তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কিনলাম হাওড়া পর্যন্ত। আর দুইখানা প্লাটফর্ম টিকিট কিনে স্টেশনের ভিতরে আসলাম। মাখনের চেহারা খুব সুন্দর। দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না চাকর’ হতে পারে। আমরা শুনলাম, খান বাহাদুর আবদুল মোমন সাহেব এই বগিতে যাবেন। নূরুদ্দিন খোঁজ এনেছে। ভাবলাম, বিপদে পড়লে একটা কিছু করা যাবে। নূরুদ্দিনকে খান বাহাদুর সাহেব চিনতেন। তিনি রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বারও ছিলেন। আমরা তার গাড়ির পাশের সার্ভেন্ট ক্লাসে উঠে পড়লাম। মাখনকে বললাম, তুমি উপরে উঠে শুয়ে থাক। তোমাকে দেখলে ধরা পড়ব। এই সকল গাড়িতে বোধহয় কোনো রেলওয়ে কর্মচারী আসবে না। নূরুদ্দিনকে সামনে দিব যদি কেউ আসে। একবার এক চেকার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কোন সাহেবের লোক”? নূরুদ্দিন ঝট করে উত্তর দিল, “মোমেন সাহেব কা”। ভদ্রলোক চলে গেলেন। কিছু কিছু ফলফলাদি নূরুদ্দিন কিনত, আমরা তিনজন খেতাম। ভাত বা রুটি খাবার পয়সা নাই। তিনজনে ভাত খেতে হলে তো এক পয়সাও থাকবে না।
কোনোমতে হাওড়া পৌঁছালাম, এখন উপায় কি? পরামর্শ করে ঠিক হল, মাখন টিকিট নিয়ে সকলের মালপত্র নিয়ে বের হয়ে যাবে। মালপত্র কোথাও রেখে তিনখানা প্লাটফর্ম টিকিট নিয়ে আবার ঢুকবে। আমরা একসাথে বের হয়ে যাব।
গাড়ি থামার সাথে সাথে মাখন নেমে গেল, আমরা দুইজন ময়লা জামা কাপড় পরে আছি। দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমরা দিল্লি থেকে আসতে পারি। চশমা খুলে লুকিয়ে রেখেছি। মাখন তিনখানা প্লাটফর্ম টিকিট নিয়ে ফিরে এসেছে। তখন প্যাসেঞ্জার প্রায়ই চলে গেছে। দুই চারজন আছে যাদের মালপত্র বেশি। তাদের পাশ দিয়ে আমরা দুইজন ঘুরছি। মাখন আমাদের প্লাটফর্ম টিকিট দিল, তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে গেলাম। তখন হিসাব করে দেখি, আমাদের কাছে এক টাকার মত আছে। আমরা বাসে উঠে হাওড়া থেকে বেকার হোস্টেলে ফিরে এলাম। না খেয়ে আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে।
০৮.
সেই সময় হতে নূরুদ্দিনের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। পরে ভ্ৰমাদের বন্ধুত্বে ‘খেসারত’ তাকে দিতে হয়েছে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পরে কর্মীদের তাদের দুঃখ কষ্টের কথা অন্য কোনো নেতাদের কাছে বললে কানও দিত না। একমাত্র শহীদ সাহেবই দুঃখ কষ্ট সহানুভূতির সাথে শুনতেন এবং দরকার হলে সাহায্যও করতেন। নূরুদ্দিন পরে অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক হয়। এনোয়ার সাহেব যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে যাদবপুর হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর যাবতীয় খরচ শহীদ সাহেব বহন করতেন।
১৯৪৪ সালে ছাত্রলীগের এক বাৎসরিক সম্মেলন হবে ঠিক হল। বহুদিন সম্মেলন হয় না। কলকাতায় আমার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছুটা ছিল—বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজে কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে সাহস পেত না। আমি সমানভাবে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগে কাজ করতাম। কলকাতায় সম্মেলন হলে কেউ আমাদের দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না। যাহোক, শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকেও ভালবাসতেন। আনোয়ার সাহেব অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। ঢাকার ছাত্রলীগ ও আমাদের সাথের কেউ আনোয়ার সাহেবকে দেখতে পারত না। একমাত্র শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই ঢাকায় আনোয়ার সাহেবের দলে ছিলেন।