রেণু টেলিগ্রাম পেয়েছে। আব্বার শরীর খুবই খারাপ, তার বাবার আশা কম। ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা করবে আব্বাকে দেখতে। একটা দরখাস্তও করেছে সরকারের কাছে, টেলিগ্রামটা সাথে দিয়ে। তখন জনাব এন, এম, খান চিফ সেক্রেটারি ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তান হওয়ার পূর্ব থেকেই তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। রাত আট ঘটিকার সময় আমার মুক্তির আদেশ দিলেন। নয়টার সময় আমাকে মুক্তি দেওয়া হল। সহকর্মীদের, বিশেষ করে ইয়ার মোহাম্মদ খানকে, ভিতরে রেখে বাইরে যেতে কষ্ট হল। কারণ, তিনি আমাকে জেলগেটে দেখতে এসে গ্রেফতার হয়েছিলেন। আমি বিদায় নিবার সময় বলে গেলাম, “হয় তোমরা মুক্তি পাবা, নতুবা আবার আমি জেলে আসব।” আমি জেলগেট পার হয়ে দেখলাম, রায় সাহেব বাজারের আমাদের কর্মী নূরুদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলল, “ভাবী এইমাত্র বাড়িতে রওয়ানা হয়ে গেছেন, আপনার আব্বার শরীর খুবই খারাপ। তিনি বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজে উঠেছেন। জাহাজ রাত এগারটায় নারায়ণগঞ্জ পৌঁছাবে। এখনও সময় আছে, তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলে নারায়ণগঞ্জে যেয়ে জাহাজ ধরতে পারবেন। তাকে নিয়ে ঢাকার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। কারণ, পূর্বে এ বাড়ি আমি দেখি নাই। আমি জেলে আসার পরে রেণু এটা ভাড়া নিয়েছিল। মালপত্র কিছু রেখে আর সামান্য কিছু নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ছুটলাম। তখনকার দিনে ট্যাক্সি পাওয়া কষ্টকর ছিল। জাহাজ ছাড়ার পনের মিনিট পূর্বে আমি নারায়ণগঞ্জ ঘাটে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে রেণু আশ্চর্য হয়ে গেল। বাচ্চারা ঘুমিয়েছিল। রেণু তাদের ঘুম থেকে তুলল। হাচিনা ও কামাল আমার গলা ধরল, অনেক সময় পর্যন্ত ছাড়ল না, ঘুমালও না, মনে হচ্ছিল ওদের চোখে আজ আর ঘুম নাই।
মুক্তির আনন্দ আমার কোথায় মিলিয়ে গেছে। কারণ, আব্বার চেহারা চোখে ভেসে আসছিল। শুধু একই চিত্তা। দেখতে পারব কি পারব না? বেঁচে আছেন, কি নাই! কেবিন ছেড়ে অনেকক্ষণ বাইরে বসে রইলাম। আজ অনেক দিন পরে রাতের হাওয়া আমার গায়ে লাগছে। জেলে তো সন্ধ্যার সময়ই বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে রেণু আর আমি অনেকক্ষণ আলাপ করেছিলাম। ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। সমস্ত দিন জাহাজে থাকতে হবে, রাতে বাড়ির ঘাটে পৌঁছাব। কোন খবর কেউ জানে না। নৌকায় দুই মাইল পথ যেতে হবে। বাড়ির থেকে নৌকাও আসবে না। সমস্ত দিন উৎকণ্ঠায় কাটালাম।
পরের রাতে বাড়িতে পৌঁছে শুনলাম, আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে গিয়েছে। দেশে ডাক্তার নাই। নৌকায় আবার চৌদ্দ মাইল পথ, রাতেই রওয়ানা করলাম। পরের দিন বেলা দশটায় গোপালগঞ্জ যেয়ে আব্বার অবস্থা দেখে একটু শান্ত হলাম। আব্বা আরোগ্যের দিকে। ডাক্তার ফরিদ আহমদ সাহেব ও বিজিতেন বাবু বললেন, “ভয়ের কোন কারণ নাই।“ দুইজনই ভাল ডাক্তার। আব্বা আমাকে পেয়ে আরও ভাল বোধ করতে লাগলেন। পরের দিনই টেলিগ্রাম পেলাম, শহীদ সাহেব আমাকে শীত্র করাচিতে ডেকে পাঠিয়েছেন। আতাউর রহমান সাহেব টেলিগ্রাম করেছেন। ঐদিন রওয়ানা করার কোন কথাই উঠতে পারে না।
পরের দিন রাতে আমি খুলনা, যশোর হয়ে প্লেনে ঢাকা পৌঁছালাম। ঢাকা থেকে করাচি রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমি মনকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছি না। কারণ, শহীদ সাহেব আইনমন্ত্রী হয়েছেন কেন? রাতে পৌঁছে আমি আর তার সাথে দেখা করতে যাই নাই। দেখা হলে কি অবস্থা হয় বলা যায় না। আমি তার সাথে বেয়াদবি করে বসতে পারি। পরের দিন সকাল নয়টায় আমি হোটেল মেট্রোপোলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, “গত রাতে এসেছ শুনলাম, রাতেই দেখা করা উচিত ছিল। আমি বললাম, “ক্লান্ত ছিলাম, আর এসেই বা কি করব, আপনি তো এখন মোহম্মদ আলী সাহেবের আইনমন্ত্রী। তিনি বললেন, “রাগ করছ, বোধহয়।” বললাম, “রাগ করব কেন স্যার, ভাবছি সারা জীবন আপনাকে নেতা মেনে ভুলই করেছি কি না?” তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, “বুঝেছি, আর বলতে হবে না, বিকাল তিনটায় এস, অনেক কথা আছে।”
আমি বিকাল তিনটায় যেয়ে দেখি তিনি একলা শুয়ে বিশ্রাম করছেন। স্বাস্থ্য এখনও ঠিক হয় নাই, কিছুটা দুর্বল আছেন। আমি তাঁর কাছে বসলাম। তিনি আলাপ করতে আরম্ভ করলেন। অনেকক্ষণ আলাপ করলেন, তার সারাংশ হল গোলাম মোহাম্মদ জানিয়ে দিয়েছেন যে, মন্ত্রিসভায় যোগাদান না করলে তিনি মিলিটারিকে শাসনভার দিয়ে দেবেন। আমি বললাম, “পূর্ব বাংলায় যেয়ে সকলের সাথে পরামর্শ করে অন্য কাউকেও তো মন্ত্রিত্ব দিতে পারতেন। আমার মনে হয় আপনাকে ট্র্যাপ করেছে। ফল খুব ভাল হবে না, কিছুই করতে পারবেন না। যে জনপ্রিয়তা আপনি অর্জন করেছিলেন, তা শেষ করতে চলেছেন। তিনি আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন এবং বললেন, “কিছু না করতে পারলে ছেড়ে দেব, তাতে কি আসে যায়!” আমি বললাম, “এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আপনার যোগদান করা উচিত হয় নাই, আপনি বুঝতে পারবেন।” তিনি আমাকে পূর্ব বাংলায় কখন যাবেন তার প্রোগ্রাম করতে বললেন। আমি বললাম, “ভাসানী সাহেব দেশে না এলে এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি না দিয়ে আপনার ঢাকায় যাওয়া উচিত হবে না। তিনি রাগ করে বললেন, “তার অর্থ তুমি আমাকে পূর্ব বাংলায় যেতে নিষেধ করছ।” আমি বললাম, “কিছুটা তাই।” তিনি অনেকক্ষণ চক্ষু বন্ধ করে চুপ করে রইলেন। পরে আমাকে বললেন, আগামীকাল আসতে, ঠিক বিকাল তিনটায়। আমি থাকতে থাকতে দেখলাম, আবু হোসেন সরকার সাহেবকে হক সাহেবের নমিনি হিসাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে গ্রহণ করা হয়েছে। শহীদ সাহেব কিছুই জানেন না। এবার তিনি কিছুটা বুঝতে পারলেন যে খেলা শুরু হয়েছে।