আতাউর রহমান সাহেব, গোলাম মোহাম্মদের কাছ থেকে একটা বার্তা নিয়ে নাকি জুরিখে শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করবেন। কি বার্তা হতে পারে অনেক গবেষণা হল। আতাউর রহমান সাহেবের উচিত ছিল প্রথমে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি করা। যদি গোলাম মোহাম্মদ বা মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে কোনো আলোচনা করতে হয়, তবে প্রথমেই মওলানা ভাসানীকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং আমাদের মুক্তি দেওয়ার বন্দোবস্ত করা। আতাউর রহমান সাহেব জুরিখ থেকে ফিরে আসলেন। গোলাম মোহাম্মদ সাহেবও কিছুদিনের মধ্যে প্রোগ্রাম করলেন, ঢাকায় আসবেন। পাকিস্তানের বড়লাট ঢাকায় আসবেন ভাল কথা। পূর্ব বাংলায় তখন গভর্নর শাসন চলছে। পূবের সরকার ভেঙে দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত সরকার গঠন করতে দেওয়া হয় নাই। এমএলএরা ও কর্মীরা জেলে। আওয়ামী লীগের সভাপতি বিলাতে, জেনারেল সেক্রেটারি কারাগারে বন্দি। অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। এই অবস্থায় কি করে গোলাম মোহাম্মদকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেবার বন্দোবস্ত করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বুঝতে কষ্ট হতে লাগল। আরও দেখলাম, একটা ফুলের মালা নিয়ে আতাউর রহমান সাহেব, আর একটা মালা হক সাহেব নিয়ে তেজগা এয়ারপোর্টে গোলাম মোহাম্মদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত গোলাম মোহাম্মদ সাহেবের গলায় দুইজনই মালা দিলেন। কিছুদিন পূর্বের থেকেই আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক দলের মধ্যে মনকষাকষি চলছিল এই অভ্যর্থনার ব্যাপার নিয়ে। এটা পরিষ্কার হয়ে পড়ল। কৃষক শ্রমিক দল আর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়, একমাত্র হক সাহেবের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার উপর নির্ভর করে কিছু সংখ্যক সুবিধাবাদী লোক একজোট হয়েছে ক্ষমতার ভাগ বসানোর জন্য। এদের কোনো সংগঠন নাই, আদর্শ নাই, নীতি নাই। একমাত্র হক সাহেবই এদের সম্বল। তারা গোলাম মোহাম্মদ সাহেবকে কেন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া)কেও অভ্যর্থনা করতে পারেন; কিন্তু আওয়ামী লীগ একটা সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান—সেই প্রতিষ্ঠানের নেতারা কি করে এই অগণতান্ত্রিক ভদ্রলোককে অভ্যর্থনা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমার বুঝতে কষ্ট হল! আমি ও আমার সহবন্দিরা খুবই মর্মপীড়ায় ভুগছিলাম। আমাদের দুঃখ হল এজন্য যে, আমাদের নেতারাও ক্ষমতার লোভে পাগল হয়ে পড়েছেন। এতটুকু বুঝবার ক্ষমতা আমাদের নেতাদের হল না যে, যুক্তফ্রন্টের দুই গ্রুপকে নিয়ে খেলা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক দলকে আলাদা আলাদাভাবে তারা যোগাযোগ করছে, যাতে গোলাম মোহাম্মদ সাহেব পূর্ব বাংলায় এসে বিরাট অভ্যর্থনা পেতে পারেন। হলও তাই। কিন্তু তিনি যা করবেন, তা ঠিক করেই রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীকে দিয়ে যে তিনি যুক্তফ্রন্টকে দ্বিধাবিভক্ত করাবেন সে ক্ষমতাও তাকে দেওয়া হয়েছিল। যদিও পরে শুনেছিলাম, গোলাম মোহাম্মদ ওয়াদা করেছিলেন শহীদ সাহেব জুরিখ থেকে ফিরে আসলেই তাকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। বড় বড় শিল্পপতিরা ও কিছু সংখ্যক আমলা কিছুতেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে সেটা চাইছিলেন না।
মোহাম্মদ আলী ঢাকায় এসে গোপনে হক সাহেবের দলের সাথে বোঝাপড়া করে ফেলেছেন যে, আওয়ামী লীগকে না নিলে তার দলকে পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন করতে দিবে এবং শহীদ সাহেব যে কেউই নয় যুক্তফ্রন্টের, একথা ঘোষণা করতে হবে। তা হলেই শহীদ সাহেবকেও দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। মোহাম্মদ আলী জানতেন শহীদ সাহেবই একমাত্র লোক যে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদের দাবিদার হতে পারেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে শহীদ সাহেব এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে জনগণ তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চায়। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা জানতেন, হক সাহেবের দলের সাথে আপোস করলে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন না দিয়েও পারা যাবে। তবে আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন ছাড়া আপোস করবে না।
৮৯.
শহীদ সাহেব যখন ফিরে আসলেন রোগমুক্তির পরে, করাচিতে—তাঁকে বিরাট অভ্যর্থনা জনসাধারণ জানাল। একমাত্র জিন্নাহ ছাড়া এত বড় অভ্যর্থনা আর কেউ পায় নাই। পূর্ব বাংলা থেকে প্রায় বিশ-ত্রিশজন নেতাও তাকে অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য করাচি উপস্থিত হয়েছিলেন। আতাউর রহমান সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ সাহেব সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিলেন। শহীদ সাহেব পৌঁছাবার সাথে সাথে কৃষক শ্রমিকের লোকেরা বলে বেড়াতে লাগলেন শহীদ সাহেব যুক্তফ্রন্টের কেউই নয়, হক সাহেবই নেতা। হক সাহেব তাঁকে সমর্থন করেন না, করেন মোহাম্মদ আলীকে। মন্ত্রিসভা গঠনে গোলাম মোহাম্মদ সাহেব শহীদ সাহেবকে বললেন, এ মন্ত্রিসভায় কেউই প্রধানমন্ত্রী নন, এটা কেয়ারটেকার সরকার। শীঘ্রই শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে, তবে এখন আইনমন্ত্রী হয়ে তাকে একটা শাসনতন্ত্র দিতে হবে।
আমাদের নেতারা কি পরামর্শ শহীদ সাহেবকে দিয়েছিলেন জানি না, তবে শহীদ সাহেব ভুল করলেন, লাহোর ও ঢাকায় না যেয়ে, দেশের অবস্থা না বুঝে মন্ত্রিত্বে যোগদান করে। কৃষক শ্রমিক দলের নেতারা যাই বলুক না কেন, ঢাকায় এসে যদি যুক্তফ্রন্ট পার্টির সভা ডাকতে বলতেন এবং সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে তারপর কোনো কিছু করতেন তা হলে কারও কিছু বলার থাকত না। জনগণের চাপে কৃষক শ্রমিক দলের নেতারা তাঁকে সমর্থন করতে বাধ্য হত। জনগণ চারদিকে অন্ধকার দেখছিল। তাদের একমাত্র ভরসা ছিল শহীদ সাহেব দেশে ফিরে আসবেন এবং পাকিস্তানের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব নিবেন। আমরা জেলের ভিতরে বসে খুবই কষ্ট পেলাম এবং আমাদের মধ্যে একটা হতাশার ভাব দেখা দিল। আমি নিজে কিছুতেই তাঁর আইনমন্ত্রী হওয়া সমর্থন করতে পারলাম না। এমনকি মনে মনে ক্ষেপে গিয়াছিলাম। অনেকে আমাকে অনুরোধ করেছিল শহীদ সাহেব রোগমুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন দেশে, তাকে টেলিগ্রাম করতে। আমি বলে দিলাম “না, কোন টেলিগ্রাম করব না, আমার প্রয়োজন নাই।”