আমাকে গ্রেফতারের পূর্বেই পাক-আমেরিকান মিলিটারি প্যাক্টের বিরুদ্ধে এক যুক্ত বিবৃতি দেই। আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি ছিল স্বাধীন, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি। আমাদের বিবৃতি খবরের কাগজে বের হবার পরে আমেরিকানরা আমাদের উপরে চটে গেল। হক সাহেবের সাথে এক আমেরিকান সাংবাদিক দেখা করেন এবং তার সাথে সাক্ষাৎ করে এক রিপোর্ট আমেরিকান কাগজে ছাপিয়ে দেন। সেই রিপোের্টটাও মোহাম্মদ আলী তাঁর বিবৃতির মধ্যে উল্লেখ করেন। বিদেশী একজন সাংবাদিকের রিপোর্টের এত দাম মোহাম্মদ আলীর দেওয়ার কারণ, সেই সাংবাদিক ও তিনি দুজনেই আমেরিকান।
৮৭.
গোলাম মোহাম্মদ বেআইনিভাবে গণপরিষদ ভেঙে দিয়েছিলেন। তবু জনগণ এতে খুবই আনন্দিত হয়েছিল। কারণ, গণপরিষদের সদস্যদের হয়ত আট বৎসর পর্যন্ত থাকার আইনত অধিকার থাকলেও ন্যায়ত অধিকার ছিল না। আট বৎসর পর্যন্ত যে গণপরিষদ দেশকে একটা শাসনতন্ত্র দিতে পারে নাই, নির্বাচনে পরাজিত হয়েও যারা পদত্যাগ না করে ষড়যন্ত্র করে নির্বাচিত সদস্যদের বরখাস্ত করে, তাদের উপর জনগণের আস্থা থাকতে পারে না। যদিও গোলাম মোহাম্মদ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ কাজ করেন নাই, করেছিলেন নিজের এবং একটা অঞ্চলের একটা বিশেষ কোটারির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। অন্যায় জেনেও আমি খুশি হয়েছিলাম এই জন্য যে, এই গণপরিষদের সদস্যরা কোনোদিন শাসনতন্ত্র দিবে না। আর শাসনতন্ত্র ছাড়া একটা স্বাধীন দেশ কতদিন চলতে পারে? গণপরিষদের সদস্যদের লজ্জা না করলেও আমাদের লজ্জা করত। গণপরিষদের অধিকাংশ সদস্যই মুসলিম লীগার। মুসলিম লীগ নেতারা যখন লেজ গুটিয়ে আত্মসমর্পণ করল একমাত্র মরহুম তমিজুদ্দিন খান সাহেব গণপরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসাবে গোলাম মোহাম্মদের এই আদেশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আমরা জেলে বসে খবরের কাগজের মারফতে যেটুকু খবর পাই, তাই সম্বল, তাই নিয়েই আলোচনা করি।
কয়েকজন বন্দি মুক্তি পেয়েছেন। এখন আমি, ইয়ার মোহাম্মদ খান, দেওয়ান মাহবুব আলী, বিজয় চ্যাটার্জী, অধ্যাপক অজিত গুহ, মোহাম্মদ তোয়াহা ও কোরবান আলী এক জায়গায় থাকি। দিন আমাদের কেটে যাচ্ছে কোনোমতে। অজিত বাবু আমাদের খাওয়াদাওয়ার দেখাশোনা করতেন। বাবুর্চি তিনি ভালই ছিলেন। অসুস্থ হয়েও নিজেই পাক করতেন। তিনি মুক্তি পাওয়ার পরে তোয়াহা ভার নিল। অজিত বাবুর মত ভাল পাকাতে
পারলেও কোনোমতে চালিয়ে নিত। আমি ও দু’একজন তার পিছু নিতাম। সে রাগ হয়ে মাঝে মাঝে বসে থাকত। আবার অনুরোধ করে তাকে পাঠাতাম। তার রাগ বেশি সময় থাকত না। কোরবান আলীর একটু কষ্ট হত। ভাগে যা পড়ত তাতে তার হত না। শরীরটা বেশ ভাল ছিল, খেতেও পারত।
কোরবানকে একদিন জেলগেটে নিয়ে গেল মুক্তির কথা বলে। আমাদের কাছ থেকে যথারীতি বিদায় নিয়ে মালপত্র সাথে নিয়ে জেলগেটে হাজির হওয়ার পরে একটায় মুক্তির আদেশ এবং সাথে সাথে আর একটা কাগজ বের করলেন একজন আইবি কর্মচারী, তাকে বলা হল, যদি বন্ড দেন, তবে এখনি বাইরে যেতে পারবেন। আর বন্ড না দিলে আবার জেলের মধ্যে ফিরে যেতে হবে। কোরবান ভীষণ একগুয়ে। সে ক্ষেপে গিয়ে অনেক কথা শুনিয়ে আবার জেলের মধ্যে ফিরে আসল এবং আমাদের সকল কথা বলল। অনেক দিন কারাগারে বন্দি থাকার পরে মুক্তির আদেশ পেয়ে, জেলগেট থেকে আবার ফিরে আসা যে কত কষ্টকর এবং কত বড় ব্যথা, তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝা কষ্টকর। পরের দিন জেল কর্তৃপক্ষকে ডেকে বলে দেওয়া হল আর কোনোদিন যেন এ কাজ না করা হয়। যদি কোনো বন্ড বা মামলা থাকে পূর্বেই জানিয়ে দিতে হবে। মালপত্র নিয়ে জেলগেটে গেলে এবং আবার ফিরে আসতে হলে ভীষণ গোলমাল হবে। রাজনৈতিক বন্দিরা দরখাস্ত করে নাই যে তারা বন্ড দিবে।
কয়েকদিন পরে এক আইবি কর্মচারী আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি নিজকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেন বলে মনে হল। আমাকে বন্ড দেওয়ার কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না বা লজ্জা করছিলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, “দয়া করে ঘোরাঘুরি করবেন না। আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা থাকলে আসতে পারেন, তবে লিখে নিয়ে যান আপনার উপরওয়ালাদের জানিয়ে দিবেন, বন্ড আমার দেওয়ার কথাই ওঠে না। সরকারকেই বন্ড দিতে বলবেন, ভবিষ্যতে আর এই রকম অন্যায় কাজ যেন না করে। আর বিনা বিচারে কাউকেও বন্দি করে না রাখে।” ভদ্রলোক হাসতে লাগলেন এবং বললেন, “আপনাকে তো আমি বন্ড দিতে বলি নাই।” আমিও হেসে ফেললাম।
৮৮.
কারাগারের দিনগুলি কোনোমতে কাটছিল। খবরের কাগজে দেখলাম, আতাউর রহমান খান সাহেব জুরিখ যাচ্ছেন, শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেখান থেকে বিলাত যাবেন, মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করতে। ভাসানী সাহেবের সাথে আরও তিনজন আওয়ামী লীগ কর্মী গিয়েছিলেন। তারাও আর ফিরে আসতে পারেন নাই। প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আর এডভোকেট জমিরউদ্দিন দেশে ফিরে আসলেই তাদের গ্রেফতার করা হত। কিভাবে তারা সেখানে আছেন ভাববার কথা! খরচ কোথায় পাবেন? অনেক বাঙালি বিলাতে ছিল, তারাই নাকি থাকার জায়গা দিয়েছে আর সাহায্যও করেছে।
করাচিতে আতাউর রহমান সাহেব গোলাম মোহাম্মদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক ছিলেন তখন করাচির মাহমুদুল হক ওসমানী। তিনিও গোলাম মোহাম্মদের সাথে সাক্ষাৎ করে পূর্ব বাংলায় এসে আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই ও আরও অনেকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বুঝতে পারলাম, কিছু একটা চলছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না। আমি তো বন্দি, কেইবা আমার কথা শুনবে?