অন্যদিকে মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে গোলমাল শুরু হয়ে গেল। গোলাম মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ আলীর সাথে মনকষাকষি শুরু হয়েছে। এখন আর মোহাম্মদ আলী সুবোধ বালক’ নন। তিনি গোলাম মোহাম্মদের ক্ষমতা খর্ব করে গণপরিষদে এক আইন পাস করে নিলেন। গোলাম মোহাম্মদও ছাড়বার পাত্র নন। তিনিও আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হলেন। যে অদৃশ্য শক্তি তাকে সাহায্য করেছিল নাজিমুদ্দীন সাহেবকে পদচ্যুত করতে, সেই অদৃশ্য শক্তি তার পিছনে আছে, তিনি তা জানেন। সেই অদৃশ্য শক্তিই ধাপে ধাপে গোলমাল সৃষ্টি করার সুযোেগ দিচ্ছে। ক্ষমতা দখল করার জন্য এখন খেলা শুরু করে দিয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদে আইন পাস করে মোহাম্মদ আলী গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার এক মাস পরে, ২৩ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে গোলাম মোহাম্মদ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে গণপরিষদ ভেঙে দিলেন। গণপরিষদ ছিল সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই গণপরিষদের সদস্যরা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত দেশে কোনো শাসনতন্ত্র ইচ্ছা করেই দেন নাই। গণপরিষদ একদিকে শাসনতন্ত্র তৈরি করার অধিকারী, অন্যদিকে জাতীয় পরিষদ হিসাবে দেশের আইন পাস করারও অধিকারী। ভারত ও পাকিস্তান একই সঙ্গে স্বাধীন হয়। একই সময় দুই দেশে গণপরিষদ গঠন হয়। ভারত ১৯৫২ সালে শাসনতন্ত্র তৈরি করে দেশজুড়ে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দেয়। আবার জাতীয় নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে।
আমাদের গণপরিষদের কতক সদস্য কিছু একটা কোটারির সৃষ্টি করে রাজত্ব কায়েম করে নিয়েছে। পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক নির্বাচনে পরাজিত হয়েও এদের ঘুম ভাঙল না। এরা ষড়যন্ত্র করে পূর্ব বাংলার নির্বাচনকে বানচাল করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করল। মোহাম্মদ আলী জানতেন তাঁর সাথে আর্মি নাই, আর থাকতেও পারে না। গোলাম মোহাম্মদকেই আর্মি সমর্থন করবে। তবুও এত বড় ঝুঁকি নিতে সাহস পেলেন কোথা থেকে? নিশ্চয়ই অদৃশ্য শক্তিই তাঁকে সাহস দিয়েছিল। পাঞ্জাবের যে কোটারি পাকিস্তান শাসন করছিল, তারা জানে, পূর্ব বাংলার এই ভদ্রলোকদের যতদিন ব্যবহার করা দরকার ছিল, করে ফেলেছে। এদের কাছ থেকে আর কিছু পাওয়ার নাই। আর এরাও পূর্ব বাংলার জনমতের চাপে মাঝে মাঝে বাধা সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীরা যুক্তফ্রন্টের জয়ের পরে এদের অবস্থাও বুঝতে পেরেছে। এরা যে পূর্ব বাংলার লোকের প্রতিনিধি নয় তাও জানা হয়ে গেছে।
মোহাম্মদ আলী তাঁহার সহকর্মীদের ত্যাগ করে আবার গোলাম মোহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করে কেয়ারটেকার সরকার গঠন করেন। এবারে তিনি পূর্বের চেয়ে বেশি গোলাম মোহাম্মদ ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর হাতের মুঠোয় চলে আসলেন। যদিও তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন, কিন্তু সত্যিকারের ক্ষমতার মালিক ছিলেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। আইয়ুব খানকে প্রধান সেনাপতি ও ইস্কান্দার মির্জাকে মন্ত্রী করে দেশটাকে আমলাদের হাতে তুলে দেওয়া হল। আইয়ুব সাহেবের মনে উচ্চাকাক্ষার সৃষ্টি পূর্বেই হয়েছিল। তার প্রমাণ আইয়ুব খানের আত্মজীবনী ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’। তিনি এ বইতে স্বীকার করেছেন যে, ১৯৫৪ সালের ৪ঠা অক্টোবর লন্ডনের হোটেলে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে তাঁর মতামত লিখেছেন। কেন তিনি শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে লিখতে গেলেন? তিনি পাকিস্তান আর্মির প্রধান সেনাপতি, তিনি শত্রুর আক্রমণের হাত থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করবেন। সেইভাবে পাকিস্তানের আর্মড ফোর্সকে গড়ে তোলাই হল তাঁর কাজ।
গোলাম মোহাম্মদ আর চৌধুরী মোহাম্মদ আলী যে চক্রান্তের খেলা শুরু করেছিলেন, তারা সাহস কোথা থেকে পেয়েছিলেন? নিশ্চয়ই জেনারেল আইয়ুব খান সকল কিছু বুঝেও চুপ করেছিলেন। রাজনীতিবিদরা নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ করে হেয়প্রতিপন্ন হয় এবং পাকিস্তানের জনগণ তাদের উপর থেকে আস্থা হারাতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় নেতাহীন ও নীতিহীন মুসলিম লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য সুযোগ করে নিতে চেষ্টা করতে লাগল। যখন গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হল তখনই দেখা গেল তথাকথিত লীগ নেতারা অনেকেই আবার মন্ত্রীর গদি অলঙ্কৃত করল। আর মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী আবার মন্ত্রিত্ব পেয়ে দলের ও দেশের কথা ভুলে গেলেন।
মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানকে একটা ব্লকের দিকে নিয়ে গেলেন। দুনিয়া তখন দুইটা ব্লকে ভাগ হয়ে পড়েছে। একটা রাশিয়ান ব্লক বা
সমাজতান্ত্রিক ব্লক, আর একটা হল আমেরিকান রক যাকে ডেমোক্রেটিক ব্লক বা ধনতন্ত্রবাদী ব্লক বলা যেতে পারে—যদিও মরহুম লিয়াকত আলীর সময় থেকেই পাকিস্তান আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। ১৯৫৪ সালের মে মাসে পাকিস্তান-আমেরিকা মিলিটারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং পরে পাকিস্তান সিয়াটো ও সেন্টো বা বাগদাদ চুক্তিতে যোগদান করে পুরাপুরি আমেরিকার হাতের মুঠোর মধ্যে চলে যায়। এই দুইটা চুক্তিই রাশিয়া ও চীনের বিরোধী বলে তারা ধরে নিল। চুক্তির মধ্যে যা আছে তা পরিষ্কারভাবে কমিউনিস্টবিরোধী চুক্তি বলা যেতে পারে। নয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানের উচিত ছিল নিরপেক্ষ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। আমাদের পক্ষে কারও সাথে শত্রুতা করা উচিত না। সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুভাবে বাস করা আমাদের কর্তব্য। কোনো যুদ্ধ জোটে যোগদান করার কথা আমাদের চিন্তা করাও পাপ। কারণ, আমাদের বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য সাহায্য করা দরকার, দেশের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও তা জরুরি।