ঢাকা জেলে তখন একজন এ্যাংলো ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট ছিল, তার নাম মিস্টার গজ। সত্যি কি না বলতে পারি না, তবে জনতা গজের বিচার চাই, গজ নিজে গুলি করেছে’— ইত্যাদি বলে চিৎকার করতে শুরু করেছে। গজের বাসা জেলগেটের সামনেই। কে যেন বলে দিয়েছে, এটা গজের বাড়ি। জনতা গজের বাড়ি আক্রমণ করে ফেলেছে। যারা উপস্থিত ছিলেন—মন্ত্রী, নেতা এবং সরকারি কর্মচারী তাঁরা আমাকে অনুরোধ করল বাইরে যেতে। এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে, একজন আর্মড পুলিশও এক ঘণ্টা হয়ে গেছে, এসে পৌঁছায় নাই। আমি বাইরে যেয়ে জনতার মোকাবেলা করলাম। নিজের হাতে অনেককে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে নিবৃত্ত করলাম। কর্মীদের নিয়ে মি, গজের বাড়ির বারান্দা থেকে উন্মত্ত জনতাকে ফেরত আনলাম। একটা গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করলাম গোলমাল না করতে, শাস্তি বজায় রাখতে। বললাম, সরকার বিচার করবে অন্যায়কারীর। মাইক্রোফোন নাই। গলায় কুলায় নাই। আবার গজের বাড়ির দিকে জনতা ছুটেছে। আবার আমি কর্মীদের নিয়ে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তার বাড়ি রক্ষা করলাম। আওয়ামী লীগের অনেক কর্মীও তখন পৌঁছে গেছে। আমি যখন লোকদের শান্ত করে জেলগেটের দিকে ফেরাই, ঠিক সেই সময় আইজিপি দোহা সাহেব কয়েকজন পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন। তিনি আমার হাত ধরে ফেললেন এবং বললেন, “আপনি গ্রেফতার।” আমি বললাম, “খুব ভাল।” জনতা চিকার করে উঠে এবং আমাকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। আমি তাদের বোঝাতে লাগলাম। আবার দুই-তিন মিনিট পরে দোহা সাহেব ফিরে এসে বললেন, “আপনাকে অন্ধকারে চিনতে পারি নাই। ভুল হয়ে গেছে। চলুন জেলগেটে যাই।” আমি তার সাথে জেলগেটের ভিতরে পৌঁছালাম এবং বললাম, “প্রায় দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে গোলমাল শুরু হয়েছে, আপনি এখন পুলিশ নিয়ে হাজির হয়েছেন। এতক্ষণ পর্যন্ত শান্তি রক্ষা আমাদেরই করতে হয়েছে। যা ভাল বোঝেন করেন। আমার কি প্রয়োজন। লালবাগ পুলিশ লাইন থেকে জেলগেট এক মাইলও হবে না, আর আপনার পুলিশ ফোর্স পৌঁছাতে এত সময় লাগল।” আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। জনতা একেবারে জেলগেটের সামনে এসে পড়েছে। আমরা দেখলাম, এখন পুলিশ লাঠিচার্জ বা গুলি করতে আরম্ভ করবে। কেউই জনতাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে না। সরকারি পাবলিসিটি ভ্যানও আসতে বলা হয় নাই যে মাইক্রোফোন দিয়ে বক্তৃতা করে লোকদের বোঝানো যায়। খালি গলায় চিৎকার করে কাউকেও শোনানো যাবে না। যারা সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের রুমে বসেছিলেন তাদের বলে জনতাকে নিয়ে এক মিছিল করে রওয়ানা করলাম। আমাদের অনেক কর্মীও বাইরে ছিল। আমি বাইরে এসে জনতাকে বললাম, “চলুন এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করার জন্য মিছিল করা যাক।” আমি হাঁটা দিলাম। প্রায় শতকরা সত্তরজন লোক আমার সাথে রওয়ানা করল। আমি সদরঘাট পর্যন্ত দেড় মাইল পথ এদের নিয়ে এলাম।
আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে পরের দিন পল্টন ময়দানে এক সভা করব যোবণা করলাম। এটা খুবই অন্যায়, জেল ওয়ার্ডার কেন জেল এরিয়ার বাইরে যেয়ে গুলি করবে? আর কার অনুমতি নিয়েছে? কে ম্যাগজিন খুলে দিয়েছে? ওয়ার্ডারদের কাছে তো রাইফেল সব সময় থাকে না। আমি যখন আওয়ামী লীগ অফিসে বসে আলাপ করছিলাম তখন রাত প্রায় দশটা। আবার খবর এল, জেলগেটে গুলি হয়েছে। একজন লোক মারা গেছে। আমি আর জেলগেটে যাওয়া দরকার মনে করলাম না। আতাউর রহমান সাহেবকে টেলিফোনে বললাম, সভা ডেকে দিয়েছি, তিনি সম্মতি দিলেন।
পরের দিন পল্টন ময়দানে বিরাট সভা হল। আমি বক্তৃতা করলাম, যে দোষী তাকে শাস্তি দেওয়া উচিত, আর যারা গুলিতে মারা গিয়াছে তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পুলিশ কেন সময় মত উপস্থিত হয় নাই, তারও একটা তদন্ত হওয়া উচিত। এর কয়েকদিন পরে যখন মন্ত্রী হলাম এবং এ ঘটনা সম্বন্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, না হয়ে থাকলে কি করা উচিত এ বিষয়েও আমরা আলোচনা করেছিলাম। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত ও গভর্নর শাসন কায়েম হওয়ার পরে আমাকে ঐ জেলগেট দাঙ্গার কেসে আসামি করা হল এবং মামলা দায়ের করা হল। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এই মামলা চলে। জনাব ফজলে রাব্বী, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে বিচার হয়। অনেক মিথ্যা সাক্ষী জোগাড় করেছিল। এমন কি মিস্টার গজের মেয়েও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল। পাবলিক সাক্ষী জোগাড় করতে পারে নাই। জেল ওয়ার্ডের মধ্যে থেকেও কয়েকজন সাক্ষী এনেছিল। তার মধ্যে দুইজন ওয়ার্ডার সত্য কথা বলে ফেলল যে, তারা আমাকে দেখেছে গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে এবং লোকদের চলে যেতেও আমি বলেছিলাম, তাও বলল। জেল সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার নাজিরউদ্দিন সরকার কি সত্য কথা বললেন না, পুলিশ যা শিখিয়ে দিয়েছিল তাই বললেন। এক একজন সাক্ষী এক এক কথা বলল এবং কিছু কিছু সরকারি সাক্ষী একথাও স্বীকার করল যে, আমি জনতাকে শান্তি রক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলাম। তাতে ম্যাজিস্ট্রেট আমার বিরুদ্ধে কোনো কিছু না থাকায় আমাকে বেকসুর খালাস দিলেন এবং রায়ে বলেছিলেন যে আমাকে শান্তিভঙ্গকারী না বলে শান্তিরক্ষকই বলা যেতে পারে। তবে এইবারে বোধহয় আমাকে দশ মাস জেলে থাকতে হল নিরাপত্তা আইনে।
৮৬.
আমি জেলে থাকবার সময় কয়েকটি ঘটনা ঘটল—যাতে আমি ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিরা খুবই মর্মাহত হয়ে পড়লাম। গৃহবন্দি হওয়ার কিছুদিন পরেই শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেবকে দিয়ে তার সমর্থকরা এক বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাতে তিনি অন্যায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি যুক্তফ্রন্টের নেতা, তার এই কথায় আমাদের সকলের মাথা নত হয়ে পড়ল। যারা আমরা জেলে ছিলাম তাদের মনের অবস্থা কি হয়েছিল তা লেখা কষ্টকর। খবরের কাগজ দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তাঁর মনে দুর্বলতা আসতে পারে। যারা বাইরে ছিলেন তাঁরা কি করলেন। সমস্ত জনসাধারণ আমাদের সমর্থন করেছিল। হাজার হাজার কর্মী কারাগারে বন্দি। আমি ও আমার সাথে যারা বন্দি ছিল তারা এক জায়গায় বসে আলোচনা করলাম এবং স্থির করলাম এই কৃষক শ্রমিক দলের সাথে আর রাজনীতি করা যায় না। এদিকে কারাগারে বসেও খবর পেতে লাগলাম যে, কৃষক শ্রমিক দলের কয়েকজন নামকরা নেতা—যাঁরা ১৯৫৩ সালে মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন তারা গোপনে গোপনে মোহাম্মদ আলীর সাথে আলোচনা চালিয়েছেন কিভাবে আবার মন্ত্রিত্ব পেতে পারেন। দরকার হলে আওয়ামী লীগের সাথে কোনো সম্পর্ক তারা রাখবেন না। আদমজী মিলের এতবড় দাঙ্গার সাথে জড়িত সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে মিস্টার ইস্কান্দার মির্জা গভর্নর হয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।