জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে আসবার সময় ইদ্রিস সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক প্রফেসর আবদুল হাই সাহেব কোথায় থাকেন?” আমি তাকে বললাম, “জানলেও বলব না। কি করে আশা করতে পারেন যে, আপনাকে বলব?” দশ-পনের দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রায় তিন হাজার কর্মী ও সমর্থক গ্রেফতার করা হল। অন্যান্য দলের সামান্য কয়েকজন কর্মী, আর কয়েকশত ছাত্র, এবং পঞ্চাশজনের মত এমএলএকে গ্রেফতার করা হল। গণতান্ত্রিক দলের কয়েকজন এমএলএকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। ঢাকা জেলের দেওয়ানি ওয়ার্ডে ও সাত সেলে কোরবান আলী, দেওয়ান মাহবুব আলী, বিজয় চ্যাটার্জী, খন্দকার আবদুল হামিদ, মির্জা গোলাম হাফিজ, ইয়ার মোহাম্মদ খান, মোহাম্মদ তোয়াহাকে রাখা হয়েছিল। পরে প্রফেসর অজিত গুহ ও মুনীর চৌধুরীকেও গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল। হক সাহেবকে নিজ বাড়িতে অন্তরীণ করেছে।
৬ই জুন তারিখে আবু হোসেন সরকার সাহেবের বাড়িতে যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পার্টির সভা আহ্বান করা হয়। সামান্য কয়েকজন এমএলএ উপস্থিত হয়েছিলেন। কয়েকজন ভূতপূর্ব মন্ত্রীও এসেছিলেন। পুলিশ এসে সভা করতে নিষেধ করলে সকলে সভা ত্যাগ করে যার যার বাড়িতে রওয়ানা করেন।
পূর্ব বাংলায় গভর্নর শাসন জারি করার দিন প্রধানমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী যে বক্তৃতা রেডিও মারফত করেন, তাতে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেবকে রাষ্ট্রদ্রোহী’ এবং আমাকে ‘দাঙ্গাকারী’ বলে আক্রমণ করেন। আমাদের নেতারা যারা বাইরে রইলেন, তারা এর প্রতিবাদ করারও দরকার মনে করলেন না। দেশবাসী ৬ই জুনের দিকে চেয়েছিল, যদি নেতারা সাহস করে প্রোগ্রাম দিত তবে দেশবাসী তা পালন করত। যেসব কর্মী গ্রেফতার হয়েছিল তারা ছাড়াও যারা বাইরে ছিল তারাও প্রস্তুত ছিল। আওয়ামী লীগের সংগ্রামী ও ত্যাগী কর্মীরা নিজেরাই প্রতিবাদে যোগ দিতে পারত। যুক্তফ্রন্টের তথাকথিত সুবিধাবাদী নেতাদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে তাও তারা করতে পারল না। অনেক কমই চেষ্টা করে গ্রেফতার হয়েছিল। যদি সেইদিন নেতারা জনগণকে আহ্বান করত তবে এতবড় আন্দোলন হত যে কোনোদিন আর ষড়যন্ত্রকারীরা সাহস করত না বাংলাদেশের উপর অত্যাচার করতে। শতকরা সাতানব্বই ভাগ জনসাধারণ যেখানে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিল ও সমর্থন করল, শত প্রলোভন ও অত্যাচারকে তারা জক্ষেপ করল না-সেই জনগণ নীরব দর্শকের মত তাকিয়ে রইল। কি করা দরকার বা কি করতে হবে, এই অত্যাচার নীরবে সহ্য করা উচিত হবে কি না, এ সম্বন্ধে নেতৃবৃন্দ একদম চুপচাপ।
একমাত্র আতাউর রহমান খান কয়েকদিন পরে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন। ৯২(ক) ধারা জারি হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে মওলানা ভাসানী বিলাত গিয়েছেন। শহীদ সাহেব অসুস্থ হয়ে জুরিখ হাসপাতালে, আর আমি তো কারাগারে বন্দি। নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। দেড় ডজন মন্ত্রীর মধ্যে আমিই একমাত্র কারাগারে বন্দি। যদি ৬ই জুন সরকারের অন্যায় হুকুম অমান্য করে (হক সাহেব ছাড়া) অন্য মন্ত্রীরা গ্রেফতার হতেন তা হলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন শুরু হয়ে যেত। দুঃখের বিষয়, একটা লোকও প্রতিবাদ করল না। এর ফল হল ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারল যে, যতই হৈচৈ বাঙালিরা করুক না কেন, আর যতই জনসমর্থন থাকুক না কেন, এদের দাবিয়ে রাখতে কষ্ট হবে না। পুলিশের বন্দুক ও লাঠি দেখলে এরা পালিয়ে গর্তে লুকাবে। এই সময় যদি বাধা পেত তবে হাজার বার চিন্তা করত বাঙালিদের উপর ভবিষ্যতে অত্যাচার করতে।
৮৫.
এই দিন থেকেই বাঙালিদের দুঃখের দিন শুরু হল। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়। ঠিক মনে নাই, তবে দুই-তিন দিন পরে আমাকে আবার নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হল। নিরাপত্তা আইনে বন্দিদের বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকতে হয়। সরকার ভাবল, যে মামলায় আমাকে গ্রেফতার করেছে, তাতে জামিন হলেও হয়ে যেতে পারে; তাই নিরাপত্তা আইনে তাদের পক্ষে সুবিধা হবে আমাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখা। কি মামলায় আসামি করেছে আমার তা মনে নাই। আমি নাকি কাউকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছি বা লুটপাট করতে উসকানি দিয়েছি। খবর নিয়ে জানলাম, জেলগেটে একটা গোলমাল হয়েছিল আমি মন্ত্রী হওয়ার সামান্য কিছুদিন পূর্বে, সেই ঘটনার সাথে আমাকে জড়িয়ে এই মামলা দিয়েছে।
একদিন আমি আওয়ামী লীগ অফিসে ইফতার করছিলাম। ঢাকায় রোজার সময় জেলের বাইরে থাকলে আমি আওয়ামী লীগ অফিসেই কর্মীদের নিয়ে ইফতার করে থাকতাম। হঠাৎ টেলিফোন পেলাম, চকবাজারে জেল সিপাহিদের সাথে জনসাধারণের সামান্য কথা কাটাকাটি হওয়ায় জেল সিপাহিরা গুলি করেছে। একজন লোক মারা গিয়েছে এবং অনেকে জখম হয়েছে। ঢাকা কারাগার চকবাজারের পাশেই। হক সাহেব মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, আমি তখনও মন্ত্রী হই নাই। আমি আতাউর রহমান সাহেবকে টেলিফোন করলাম। তাঁর বাসা চকবাজারের কাছে। তিনিও খবর পেয়েছেন, আমাকে তার বাসায় যেতে বললেন। দরকার হলে একসাথে চকবাজার ও জেলখানায় যাওয়া যাবে। আমি পৌঁছার সাথে সাথে দুজনে দ্রুত চকবাজারে পৌঁছালাম। অনেক লোক জমা হয়ে আছে এবং তারা খুবই উত্তেজিত। আমরা উপস্থিত হলে তারা আমাদের ঘিরে ফেলল এবং সকলে একসাথে চিৎকার করতে শুরু করল। সকলেই একসঙ্গে কথা বলতে চায়, কি ঘটনা ঘটেছে জানাতে। আমরা যখন তাদের অনুরোধ করলাম, এক একজন করে বলতে, তখন তারা একটু শান্ত হল এবং ঘটনাটা বলল। একজন ওয়ার্ডারের সাথে এক পানের দোকানদারের কথা কাটাকাটি এবং পরে মারামারি হয়। এই অবস্থায় দু’চারজন ওয়ার্ডারও হাজির হয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডারের পক্ষ নেয়, আর জনসাধারণ দোকানদারের পক্ষ নেয়। সিপাহিরা একটু বেশি মার খায়। তারা ব্যারাকে ফিরে গিয়ে রাইফেল এনে গুলি করতে শুরু করে। এতে অনেক লোক জখম হয় এবং তিনজন আহত লোককে ধরে জেল এরিয়ার ভিতরে নিয়ে যায়। অনেক লোক তখন জমা হয়েছে। আমরা দুইজনই তাদের শান্ত হতে বলে, জেলগেটের দিকে রওয়ানা করেই দেখতে পেলাম, সৈয়দ আজিজুল হক ওরফে নান্না মিয়া (তখন মন্ত্রী) খবর পেয়ে এসেছেন। তাঁর সাথে একজন বিশিষ্ট সরকারি কর্মচারী আছেন। আমরা একসাথে জেলগেটের ভিতরে পৌঁছালাম। সেখানে জেল সুপারিনটেনডেন্ট ও জেলারের সাথে আলাপ হল। এ সময় আরও দু’একজন মন্ত্রী, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ডিভিশনাল কমিশনার এসে হাজির হয়েছেন। জনসাধারণ মন্ত্রীদের ও আমাদের দেখে একদম জেলগেটের সামনে এসে জড়ো হয়েছে। হাজার হাজার লোক চিক্কার করতে আরম্ভ করেছে।