ঢাকায় এসে দেখলাম, বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা সকলের সাথে দেখা করে যার যার বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। আমৱা হক সাহেবের পিএ সাজেদ আলীকে করাচি রেখে এসেছিলাম। যদি কোনো খবর থাকে তাহলে টেলিফোন করে যেন জানিয়ে দেয়।
৮৪.
বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনও ভাল করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, “আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছ।” রেণু ভাবতে লাগল, আমি গোসল করে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করছিলাম। বেলা তিনটায় টেলিফোন এল, কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করেছে।২৮ মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব বাংলার গভর্নর, আর এন, এম, খানকে চিফ সেক্রেটারি করা হয়েছে।
আমি তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে আতাউর রহমানের বাড়িতে এসে তাকে নিয়ে হক সাহেবের বাড়িতে গেলাম এবং তাঁকে অনুরোধ করলাম ক্যাবিনেট মিটিং ডাকতে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অন্যায় আদেশ আমাদের মানা উচিত হবে না এবং এটাকে অগ্রাহ্য করা উচিত। তিনি বললেন, কি হবে বুঝতে পারছি না, অন্যদের সাথে পরামর্শ কর। নান্না মিয়াকে বললাম, তিনি কিছুই বলতে পারছেন না, মনে হল সকলে ভয় পেয়ে গেছেন। আতাউর রহমান সাহেব রাজি ছিলেন, যদি সকলে একমত হতে পারতাম। মন্ত্রীদের পাওয়া গেল না, হক সাহেব দোতলায় বসে রইলেন। আতাউর রহমান সাহেবকে বললাম, “আপনি দেখেন, সকলকে ডেকে আনতে পারেন কি না? আমি আওয়ামী লীগ অফিস থেকে কাগজপত্রগুলি সরিয়ে দিয়ে আসি। অফিস তালা বন্ধ করে দিতে পারে।”
আমি আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে দরকারি কাগজপত্র সরিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে অন্য পথ দিয়ে পুলিশ অফিসে এসে পাহারা দিতে আরম্ভ করল। আমি আবার নান্না মিয়ার বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে আমাকে জানাল, বড় বড় পুলিশ কর্মচারীরা আমাকে খুঁজতে এসেছিল। বাড়িতে ফোন করে জানলাম সেখানেও গিয়েছিল। আমি রেণুকে বললাম, “আবার আসলে বলে দিও শীঘ্র আমি বাড়িতে পৌঁছাব।” বিদায় নেওয়ার সময় অনেককে বললাম, “আমি তো জেলে চললাম, তবে একটা কথা বলে যাই, আপনারা এই অন্যায় আদেশ নীরবে মাথা পেতে মেনে নেবেন না। প্রকাশ্যে এর বাধা দেওয়া উচিত। দেশবাসী প্রস্তুত আছে, শুধু নেতৃত্ব দিতে হবে আপনাদের। জেলে অনেকের যেতে হবে, তবে প্রতিবাদ করে জেল খাটাই উচিত। সেখান থেকে এসে পথে কয়েকজন কর্মীর সাথে দেখা করতে চেষ্টা করলাম, কাউকেও পাওয়া গেল না। আমি সরকারি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশা ভাড়া করে বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। দেখলাম, কিছু কিছু পুলিশ কর্মচারী আমার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আমি রিকশায় পৌঁছালাম, তারা বুঝতে পারে নাই। রেণু আমাকে খেতে বলল, খাবার খেয়ে কাপড় বিছানা প্রস্তুত করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব এহিয়া খান চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, “আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধহয় আমাকে গ্রেফতার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি গাড়ি পাঠিয়ে দেন। তিনি বললেন, “আমরা তো হুকুমের চাকর। গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি প্রস্তুত হয়ে থাকুন। আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য বার বার টেলিফোন আসছে। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। রেণু আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল এবং কাদতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের ওঠাতে নিষেধ করলাম। রেণুকে বললাম, “তোমাকে কি বলে যাব, যা ভাল বোঝ কর, তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও।”
বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলে গিয়েছিলাম, যদি রেণু বাড়ি না যায় তা হলে একটা বাড়ি ভাড়া করে দিতে। ইয়ার মোহাম্মদ খান ও আল হেলাল হোটেলের মালিক হাজী হেলাল উদ্দিন রেণুকে বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছিল এবং তখন দেখাশোনাও করেছিল। কিছুদিন পরই ইয়ার মোহাম্মদ খান রেণুকে নিয়ে জেলগেটে আমার সাথে দেখা করতে আসলে তাকেও জেলগেটে গ্রেফতার করে। ইয়ার মোহাম্মদ খান ঢাকা থেকে এমএলএ হয়েছিলেন।
আধা ঘণ্টা পরে গাড়ি এসে হাজির। অনেক লোকই বাড়িতে ছিল, গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে অনেকেই অন্ধকারে পালিয়ে গেছে। আমি গাড়িতে উঠে রওয়ানা করলাম। গোপালগঞ্জের অল্প বয়সের এক কর্মী শহিদুল ইসলাম গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল। আমি গাড়ি থেকে নেমে তাকে আদর করে বুঝিয়ে বললাম, “কেন কাঁদিস, এই তো আমার পথ। আমি একদিন তো বের হব, তোর ভাবীর দিকে খেয়াল রাখিস।”
জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে আমাকে নিয়ে আসা হল। তিনি বসেই ছিলেন, আমাকে বললেন, “কি করব বলুন! করাচি আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমরা তো জানি আপনাকে খবর দিলে আপনি চলে আসবেন। জেলের ভয় তো আপনি করেন না। তার কাছে অনেক টেলিফোন আসছিল, আমার আর তার কামরায় থাকা উচিত না। তাকে বললাম, “আমাকে জেলে পাঠিয়ে দেন। খুবই ক্লান্ত, গতরাতেও ঘুম হয় নাই প্লেনে।”
তিনি আমাকে পাশের রুমে নিয়ে বসতে দিলেন। ইদ্রিস সাহেব তখন ঢাকার ডিআইজি। তিনি আসলেন, আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করলেন। সিগারেট বা অন্য কিছু লাগবে কি না জানতে চাইলেন। আমি তাঁকেও বললাম, তাড়াতাড়ি জেলে পাঠিয়ে দিলেই খুশি হব। তিনি চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরে একজন ইন্সপেক্টর এসে একটা ওয়ারেন্ট তৈরি করতে লাগলেন। একটা মামলা আমার নামে করা হল; তাতে দেখলাম, ডাকাতি ও খুন করার চেষ্টা, লুটতরাজ ও সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, আরও কতগুলি ধারা বসিয়ে দিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ‘ডিভিশন’ লিখে দিলেন। আমি রাত সাড়ে বারোটা কি একটা হবে, জেলগেটে পৌঁছালাম। দেখি, আমিই একলা আর কাউকেও আনা হয় নাই। কয়েক মিনিট পরে দেখলাম, মির্জা গোলাম হাফিজ আর সৈয়দ আবদুর রহিম মোক্তারকে আনা হয়েছে। তিনজনকে দেওয়ানি ওয়ার্ডে রাখা হল।