আমি অসুস্থ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে দেখতে গেলাম। শহীদ সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না, কথা বলতেও কষ্ট হয়। ডাক্তার বাইরের লোকের সাথে দেখা করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। আমাকে দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। বেবী (শহীদ সাহেবের একমাত্র মেয়ে) আমাকে বলে দিয়েছিল, রাজনীতি নিয়ে আলাপ যেন না করি। তিনি আস্তে আস্তে আমার কাছে রাজনীতি বিষয়েই জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। আমি দু’এক কথা বলেই চুপ করে যাই। তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন, “বিরাট খেলা শুরু করেছে মোহাম্মদ আলী ও মুসলিম লীগ নেতারা।
হক সাহেব আমাকে বললেন, “গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তার সাথে আমাদের দেখা করতে অনুরোধ করেছেন। আমরা বড়লাটের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। তিনি যে কামরায় শুয়ে শুয়ে দেশ শাসন করতেন, সেই ঘরেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। তিনি খুবই অসুস্থ। হাত-পা সকল সময়ই কাঁপে। কথাও পরিষ্কার করে বলতে পারেন না। তিনি হক সাহেবের সাথে আলাপ করলেন। আমার নাম ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, উপস্থিত আছি কি না! হক সাহেব আমাকে দেখিয়ে দিলেন। আমি আদাব করলাম। তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বসালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “লোকে বলে, আপনি কমিউনিস্ট, একথা সত্য কি না?” আমি তাকে বললাম, “যদি শহীদ সাহেব কমিউনিস্ট হন, তাহলে আমিও কমিউনিস্ট। আর যদি তিনি অন্য কিছু হন তবে আমিও তাই।” তিনি হেসে দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, “আপনি এখনও যুবক, দেশের কাজ করতে পারবেন। আমি আপনাকে দোয়া করছি। আপনাকে দেখে আমি খুশি হলাম।” কথাগুলি বুঝতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, কারণ কথা তিনি পরিষ্কার করে বলতে পারেন না। মুখটাও বাঁকা হয়ে গেছে। হাত-পা শুকিয়ে গিয়েছে। আল্লাহ সমস্ত বুদ্ধি আর মাথাটা ঠিক রেখে দিয়েছেন।
আমরা পরের দিনই খবর পেলাম পূর্ব বাংলায় গভর্নর শাসন দিবে, মন্ত্রিসভা ভেঙে দিবে, এই নিয়ে আলোচনা চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারি জনাব ইসহাক সাহেবকে আদেশ দিয়েছে, যাতে আমরা পূর্ব বাংলায় আসতে না পারিযাতে আমাদের প্লেনের টিকিট করতে না দেওয়া হয়। তিনি অস্বীকার করলেন এই কথা বলে যে, এখনও তাঁরা মন্ত্রী। আইনত তিনি আমাদের আদেশ মানতে বাধ্য। তাঁকে আরও বলা হয়েছিল, তাঁর রিপোর্ট পরিবর্তন করতে। তিনি তাও করতে আপত্তি করলেন। এটা না করার ফল হিসাবে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং অনেক দিন পর্যন্ত ছুটি ভোগ করতে বাধ্য করেছিল। আমি ও আতাউর রহমান সাহেব এ খবর পেয়েছিলাম। তাই হক সাহেবকে যেয়ে বললাম, “আমরা আজই ঢাকা রওয়ানা করব। কারণ, আজ না যেতে পারলে আরও কয়েকদিন থাকতে হবে। প্লেনের টিকিট পাওয়া যাবে না।” হক সাহেবকে অবস্থা বুঝিয়ে বললে তিনিও নান্না মিয়াকে ডেকে বললেন, তিনিও যাবেন। নান্না মিয়াও রাজি হলেন। মোহন মিয়া ও আশরাফউদ্দিন চৌধুরী সাহেব করাচি থেকে তদ্বির করবেন, কোনো কিছু করা যায় কি না।
আমরা টিকিট করতে হুকুম দিয়ে শহীদ সাহেবের কাছে উপস্থিত হলাম। তাঁকে কিছু কিছু বললাম। তিনি অতি কষ্টে আমাকে বললেন, “দু’একদিনের মধ্যে চিকিৎসার জন্য আমাকে জুরিখ যেতে হবে, টাকার অভাব হয়ে পড়েছে।” আমি বললাম, “ঢাকা যেয়ে কিছু টাকা বেবীর কাছে পাঠিয়ে দিব।” মনে মনে দুঃখ করলাম, আর ভাবলাম, যে লোক হাজার হাজার টাকা উপার্জন করে গরিবকে বিলিয়ে দিয়েছেন আজ তার চিকিৎসার টাকা নাই, একেই বলে কপাল!
বোধহয় ২৯শে মে হবে, আমরা রাতের প্লেনে রওয়ানা করলাম। দিল্পি কলকাতা হয়ে ঢাকা পৌঁছাবে বিওএসি প্লেন। আমাদের সাথে চিফ সেক্রেটারি হাফিজ ইসহাক ও আইজিপি শামসুদ্দোহা সাহেব ঢাকা রওয়ানা করলেন। দোহা সাহেব কেন এবং কার হুকুমে করাচি গিয়েছিলেন আমার জানা ছিল না। হক সাহেব পরে আমাকে বলেছেন, তিনিই হুকুম দিয়েছেন। কলকাতা পৌঁছাবার কিছু সময় পূর্বে জনাব দোহা হক সাহেবকে যেয়ে বললেন, “স্যার আমার মনে হয় আপনার আজ কলকাতা থাকা উচিত। কি হয় বলা যায় না, এদের ভাবসাব ভাল দেখলাম না। রাতেই ইস্কান্দার মির্জা এবং এন. এম. খান ঢাকায় মিলিটারি প্লেনে রওয়ানা হয়ে গেছেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে কোনো ঘটনা হয়ে যেতে পারে। যদি কোনো কিছু না হয়, তবে আগামীকাল প্লেন পাঠিয়ে আপনাদের নেওয়ার বন্দোবস্ত করব।” হক সাহেব সবই বুঝতেন, তিনি নান্না মিয়াকে ও আমাকে দেখিয়ে দিয়া বললেন, “ওদের সাথে আলাপ করুন।” আমার কাছে দোহা সাহেব এসে ঐ একই কথা বললেন। আমি তাকে পরিষ্কার বলে দিলাম, “কেন কলকাতায় নামব? কলকাতা আজ আলাদা দেশ। যা হয় ঢাকায়ই হবে।” নান্না মিয়াও একই জবাব দিলেন। আমার বুঝতে বাকি থাকল না, কেন তিনি গায়ে পড়ে এই পরামর্শ দিতে এসেছেন। তিনি যে এই পরামর্শ দিচ্ছিলেন তা করাচি থেকেই ঠিক করেই এসেছেন। পাকিস্তানী শাসকচক্র দুনিয়াকে দেখতে চায়, ‘হক সাহেব দুই বাংলাকে এক করতে চান, তিনি পাকিস্তানের দুশমন, তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী। আর আমরা তাঁর এই রাষ্ট্রদ্রোহী কাজের সাথী।
কলকাতা এয়ারপোর্টে নামবার সাথে সাথে খবরের কাগজের প্রতিনিধিরা হক সাহেবকে ঘিরে ফেলল এবং প্রশ্ন করতে শুরু করল। তিনি মুখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর মুখ বন্ধ, আর আমাকে দেখিয়ে দিলেন। প্রতিনিধিরা আমার কাছে এলে, আমি বললাম, “এখানে আমাদের কিছুই বলার নাই। যদি কিছু বলতে হয়, ঢাকায় বলা যাবে।” কলকাতা এয়ারপোর্টে আমাদের প্রায় এক ঘণ্টা দেরি করতে হল। আবার দোহা সাহেব এসে বললেন, “টেলিফোন করে খবর পেলাম, সমস্ত ঢাকা এয়ারপোর্ট মিলিটারি ঘিরে রেখেছে। চিন্তা করে দেখেন, কি করবেন?” আমি তাকে বললাম, “ঘিরে রেখেছে ভাল, আমাদের তাতে কি, আমরা ঢাকায়ই যাব। বিদেশে এক মুহূর্তও থাকব না।” প্লেনে উঠে ভাবলাম, দোহা সাহেব পুলিশে চাকরি করেন, তাই নিজেকে খুবই বুদ্ধিমান মনে করেন। আমরা রাজনীতি করি, তাই এই সামান্য চালাকিটাও বুঝতে পারি না।।