কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে যে সুযোগ খুঁজতে ছিল এই দাঙ্গায় তা সৃষ্টি করতে সক্ষম হল। মোহাম্মদ আলী মুসলিম লীগ ও পশ্চিমা শিল্পপতিদের যোগসাজশে যে যুক্তফ্রন্টকে ভাঙতে চেষ্টা করছিল আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় যোগদান করায় তা সফল হল না। তাই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ও তাদের দালালদের সাহায্যে চেষ্টা করে হতাশ হয়ে পরে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে লাগল। এ সুযোগ সৃষ্টি করতে পারত না, যদি প্রথম দিনই যুক্তফ্রন্ট পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা গঠন করে শাসনব্যবস্থাকে কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করত।
যুক্তফ্রন্ট ইলেকশনে জয়লাভ করার পরে বড় বড় সরকারি আমলাদের মধ্যে বাসের সঞ্চার হয়েছিল। অনেকে প্রত্যক্ষভাবে মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচার করেছিল। আওয়ামী লীগ প্রথমে মন্ত্রিসভায় যোগদান না করায় তাদের প্রাণে পানি এসেছিল। যোগদান করার পরে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়ল এবং ষড়যন্ত্রে যোগদান করল। তবে হাফিজ মোহাম্মদ ইসহাক, চিফ সেক্রেটারি এই পরিবর্তনকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছিলেন।
পরের দিন আবার আমি আদমজী জুটমিলে যাই এবং যাতে শ্রমিকদের খাবার ও থাকার কোন কষ্ট না হয় তার দিকে নজর দিতে সরকারি কর্মচারীদের অনুরোধ করি। সেক্রেটারিয়েটে যেয়ে চিফ সেক্রেটারিকে ডেকে তার সঙ্গে আলাপ করলাম। ঐদিকে কাকে কোন মন্ত্রণালয় দেওয়া হবে তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেখানেও ষড়যন্ত্র আরম্ভ হয়েছে। আওয়ামী লীগারদের যেন ভাল দপ্তর দেওয়া না হয় সে চেষ্টা চলছে। এক মহাবিপদে পড়া গেল। মোহন মিয়া সাহেবই হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করে উল্টাপাল্টা করতে লাগলেন। আমি হক সাহেবকে বললাম, “এ সমস্ত ভাল লাগে না, দরকার হয় মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যাব।”
পরের দিন দফতর ভাগ করা হল। আমাকে কো-অপারেটিভ ও এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট দফতর দেওয়া হল। এগ্রিকালচার আবার আলাদা করে অন্যকে দিল। জনাব সোবহান সিএসপি, দপ্তর ভাগ বাটোয়ারা করতে মোহন মিয়াকে পরামর্শ দিতেছিল। আমি তাকে ডেকে বললাম, “আপনি আমাকে জানেন না, বেশি ষড়যন্ত্র করবেন না।” আমি হক সাহেবের কাছে আবার হাজির হয়ে বললাম, “নানা, ব্যাপার কি? এ সমস্ত কি হচ্ছে, আমরা তো মন্ত্রী হতে চাই নাই। আমাদের ভিতরে এনে এ সমস্ত ষড়যন্ত্র চলছে কেন?” তিনি আমাকে ডেকে বললেন, “করবার দে, আমার পোর্টফলিও তোকে দিয়ে দেব, তুই রাগ করিস না, পরে সব ঠিক করে দেব।” বৃদ্ধলোক, তাকে আর কি বলব, তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতে শুরু করেছেন। দরকার না হলেও আমাকে ডেকে পাঠাতেন। তিনি খবরের কাগজের প্রতিনিধিদের বলেছেন, “আমি বুড়া আর মুজিব গুড়া, তাই ওর আমি নানা ও আমার নাতি।” আমি সকলের চেয়ে বয়সে ছোট। আর হক সাহেব সকলের চেয়ে বয়সে বড়। তিনি আমাকে যে কাজই করতে বলতেন, আমি করতে লাগলাম। তার মনটা উদার ছিল, যে কারণে তাকে আমি ভক্তি করতে শুরু করলাম। ষড়যন্ত্রকারীরা যখন তাঁর কাছে না থাকত তখন তিনি উদার ও অমায়িক। খুব বেশি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাই এদের উপর তার নির্ভর করতে হত। কিন্তু যেভাবে তিনি আমাকে স্নেহ করতে আরম্ভ করেছিলেন আমার বিশ্বাস হয়েছিল এদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করা যাবে। আমি অফিসে যেয়ে ঐ ডিপার্টমেন্ট কি বুঝতে চেষ্টা করলাম, কারণ ডিপার্টমেন্ট সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। এই সময় মন্ত্রীর সরকারি বাড়িতে উঠে এল, আমিও ঢাকার মিন্টো রোডে সরকারি ভবনে ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠলাম।
৮৩.
দু’একদিন পরই হক সাহেব আমাকে বললেন, “করাচি থেকে খবর এসেছে, আমাকে যেতে হবে। তুই ও আতাউর রহমান আমার সাথে চল। নান্না, মোহন মিয়া ও আশরাফউদ্দিন চৌধুরীও যাবে, বেটাদের হাভোব ভাল না। আমি প্রস্তুত ছিলাম, কারণ আমাকে যেতেই হত। শহীদ সাহেব অসুস্থ হয়ে আছেন, তাকে দেখতে।
আমরা করাচি পৌঁছালাম। প্রথমেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সাথে আমাদের পূর্ব বাংলার সমস্যা নিয়ে আলোচনা হল। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আমাদের কি কি সাহায্যের প্রয়োজন তাও জানান হল। পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে মিথ্যা প্রচার চালানো হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট সরকারই নাকি এই দাঙ্গা সৃষ্টি করেছে। একথা কেউ কোনোদিন শুনেছে কি না আমার জানা নাই যে, সরকার নিজেই দাঙ্গা করে নিজেকে হেয় করার জন্য! আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মালিক সরকার, সে কেন দাঙ্গা করে বদনাম নিবে? দাঙ্গা বাধিয়েছে যারা পরাজিত হয়েছে তারা। করাচি থেকে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে দুনিয়ার কাছে হেয় করতে এই দাঙ্গার সৃষ্টি করা হয়। তারা সুযোগ খুঁজছে কোনো রকমে প্রাদেশিক সরকারকে বরখাস্ত করা যায় কি না? কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের সাথে আলোচনা হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া আমাদের তার রুমে নিয়ে বসতে দিলেন। হক সাহেবও আছেন সেখানে। মোহাম্মদ আলী বেয়াদবের মত হক সাহেবের সাথে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করছিল। এমন সময় মোহাম্মদ আলী আমাকে বললেন, “কি মুজিবর রহমান, তোমার বিরুদ্ধে বিরাট ফাইল আছে আমার কাছে।” এই কথা বলে, ইয়াংকিদের মত ভাব করে পিছন থেকে ফাইল এনে টেবিলে রাখলেন। আমি বললাম, “ফাইল তো থাকবেই, আপনাদের বদৌলতে আমাকে তো অনেক জেল খাটতে হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধেও একটা ফাইল প্রাদেশিক সরকারের কাছে আছে।” তিনি বললেন, “এর অর্থ।” আমি বললাম, “যখন খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তখন আপনাকে মন্ত্রী করেন নাই। আমরা যখন ১৯৪৮ সালে প্রথম বাংলা ভাষার আন্দোলন করি, তখন আপনি গোপনে দুইশত টাকা চান্দা দিয়েছিলেন, মনে আছে আপনার? পুরানা কথা অনেকেই ভুলে যায়।” হক সাহেব ও সৈয়দ আজিজুল হক সাহেব দেখলেন হাওয়া গরম হয়ে উঠছে। তখন বললেন, “এখন আমরা চলি, পরে আবার আলাপ হবে।” আমি এক ফাঁকে হক সাহেবের সাথে যে সে বেয়াদবের মত কথা বলেছিল, সে সম্বন্ধেও দু’এক কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম।