সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে এই দাঙ্গা শুরু হয়। তিন দিন পূর্বে এক অবাঙালি দারোয়ানের সাথে এক বাঙালি শ্রমিকের কথা কাটাকাটি ও মারামারি হয়। তাতে বাঙালি শ্রমিকের এক আঘাতে হঠাৎ দারোয়ানটা মারা যায়। এই নিয়ে উত্তেজনা এবং ষড়যন্ত্র শুরু হয়। দারোয়ানরা সবাই অবাঙালি। আর কিছু সংখ্যক শ্রমিকও আছে অবাঙালি। এই ঘটনা নিয়ে বেশ মনকষাকষি শুরু হয়। মিল কর্তৃপক্ষ অবাঙালিদের উসকানি দিতে থাকে। মিল অফিসে কালো পতাকা ওড়াতে অনুমতি দেয়। মিলে কাজ বন্ধ করে দিয়ে বাঙালিদের বেতন নেবার দিন ঘোষণা করে বলা হয়, বেতন নিতে মিলের ভেতরে আসতে। যখন তারা বেতন নিতে ভিতরে আসে তখন চারদিক থেকে বন্দুকধারী দারোয়ান ও অবাঙালিরা তাদের আক্রমণ করে। এই আকস্মিক আক্রমণের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে বহু লোক মারা যায়। পরে আবার বাঙালিরা যারা বাইরে ছিল, তারা অবাঙালিদের আক্রমণ করে এবং বহু লোককে হত্যা করে। নতুন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা যে সময় শপথ নিচ্ছে সেই সময় বেতন দেবার সময় ঘোষণা করার অর্থ কি? ইপিআর উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও একটা গুলিও করা হয় নাই। ফলে দাঙ্গা করে পাঁচশত লোকের উপরে মারা যায়। পুলিশ কর্মচারীরা পূর্বেই খবর পেয়েছিল, তবু কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই? মন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক সাহেবকে মিষ্টি কথা বলে মিল অফিসে বসিয়ে রেখেছে। দালা যে মিলের অন্যদিকে শুরু হয়েছে, সে খবর তাঁকে দেওয়া হয় নাই। হক সাহেব ও অন্যান্য মন্ত্রী ঢাকায় চলে এসেছেন, আমি ও মোহন মিয়া উপস্থিত আছি রাত নয়টা পর্যন্ত। জনাব মাদানী তখন ঢাকার কমিশনার এবং হাফিজ মোহাম্মদ ইসহাক সিএসপি তখন চিফ সেক্রেটারি।
আমি যখন মাদানী সাহেবকে বললাম, পাঁচশত লোক মারা গেছে, তারা বিশ্বাস করতে চান নাই। মাদানী সাহেব বললেন, পঞ্চাশ জন হতে পারে। আমি তাকে বললাম, একটা একটা করে গণনা করেছি, নিজে গিয়ে দেখে আসুন। পরে মাদানী সাহেব স্বীকার করেছিলেন। রাত নয়টায় আমাকে ও মোহন মিয়াকে জানান হল, মিল এরিয়া মিলিটারিদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। জনাব শামসুদ্দোহা তখন পুলিশের আইজি। আমাকে এসে বললেন, “স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে, মিলিটারিরা সকলে অবাঙালি।” আমি হেসে দিয়ে বললাম, “সর্বনাশের কি আর কিছু বাকি আছে। আপনি যখন পুলিশ ও ইপিআর নিয়ে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারলেন না, তখন আর মিলিটারির হাতে না দিয়ে উপায় কি?” তখন ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) প্রাদেশিক গভর্নমেন্টের অধীনে ছিল। ঢাকায় যেয়ে দেখি কি হয়েছে! চিফ মিনিস্টার নিশ্চয়ই মত দিয়েছেন। আমরা সোজা চিফ মিনিস্টারের বাড়িতে পৌঁছালাম। যেয়ে শুনতে পারলাম, তিনি আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। চিৎকার করে সকলের সঙ্গে রাগারাগি করছেন, আমাকে কেন দাঙ্গা এরিয়ায় রেখে সকলে চলে এসেছে। আমি তাঁর কাছে গেলে তিনি আমাকে খুব আদর করলেন। আমাকে বললেন, “ক্যাবিনেট মিটিং এখনই হবে, তুমি যেও না”। রাত সাড়ে দশটায় ক্যাবিনেট মিটিং বসল। ক্যাবিনেট মিটিং শুরু হওয়ার পূর্বে দেখলাম, মন্ত্রীদের মধ্যে দু’একজনকে এর মধ্যে হাত করে নিয়েছেন দোহা সাহেব। আবদুল লতিফ বিশ্বাস সাহেব মিলিটারিকে কেন ভার দেওয়া হয়েছে তাই নিয়ে চিৎকার করছেন। হক সাহেব আসলেন। সভা শুরু হওয়ার পূর্বেই চিফ সেক্রেটারি ইসহাক সাহেবকে কড়া কথা বলতে শোনা গেল। আমি প্রতিবাদ করলাম এবং বললাম, ও কথা পরে হবে। পূর্বে যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে নাই এবং এতগুলি লোকের মৃত্যুর কারণ তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এরপর ক্যাবিনেট আলোচনা শুরু হল। অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়, সে কথা আমার পক্ষে বলা উচিত না, কারণ ক্যাবিনেটে মিটিংয়ের খবর বাইরে বলা উচিত না।
মিটিং শেষ হবার পর যখন বাইরে এলাম, তখন রাত প্রায় একটা। দেখি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত কলকাতার পুরানা মুসলিম লীগ কর্মী রজব আলী শেঠ ও আরও অনেক অবাঙালি নেতা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা আমাকে বললেন, এখনই ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বের হতে। খবর রটে গেছে যে বাঙালিদের অবাঙালিরা হত্যা করেছে। যে কোনো সময় অবাঙালিদের উপর আক্রমণ হতে পারে। তাড়াতাড়ি রজব আলী শেঠ ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিড় জমে আছে তখন পর্যন্ত। আমি গাড়ি থেকে নেমে বক্তৃতা করে সকলকে বুঝাতে লাগলাম এবং অনেকটা শান্ত করতে সক্ষম হলাম। রাত চার ঘটিকায় বাড়িতে পৌঁছালাম। শপথ নেওয়ার পরে পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়িতে আসতে পারি নাই। আর দিনভর কিছু পেটেও পড়ে নাই। দেখি রেণু চুপটি করে না খেয়ে বসে আছে, আমার জন্য।
এই দাঙ্গা যে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এবং দুনিয়াকে নতুন সরকারের অক্ষমতা দেখাবার জন্য বিরাট এক ষড়যন্ত্রের অংশ সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই। কয়েকদিন পূর্বে এই ষড়যন্ত্র করাচি থেকে করা হয়েছিল এবং এর সাথে একজন সরকারি কর্মচারী এবং মিলের কোন কোন কর্মচারী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। যুগ যুগ ধরে পুঁজিপতিরা তাদের শ্রেণী স্বার্থে এবং রাজনৈতিক কারণে গরিব শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামা, মারামারি সৃষ্টি করে চলেছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আদমজী মিলের মালিক গুল মোহাম্মদ আদমজী এসব জানতেন কি না সন্দেহ।