আমি সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় যেয়ে দেখি রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে গতকাল ঢাকায় এসেছে। সে এখন ঢাকায়ই থাকবে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত হওয়া দরকার। আমি খুশিই হলাম, আমি তো মোসাফিরের মত থাকি। সে এসে সকল কিছু ঠিকঠাক করতে শুরু করেছে। আমার অবস্থা জানে, তাই বাড়ি থেকে কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে। আমি হক সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, “তোকে মন্ত্রী হতে হবে। আমি তোকে চাই, তুই রাগ করে না বলিস না। তোরা সকলে বসে ঠিক কর, কাকে কাকে নেওয়া যেতে পারে।” আমি তাকে বললাম, “আমাদের তো আপত্তি নাই। শহীদ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তার অনুমতি দরকার। আর মওলানা সাহেব উপস্থিত নাই, তার সাথেও আলোচনা করতে হবে।” আমি ইত্তেফাক অফিসে মানিক ভাই ও আতাউর রহমান খান সাহেবকে নিয়ে বসলাম। একটু পরে মোর্শেদ সাহেব, কাদের সর্দার সাহেব, কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেব আসলেন। আলোচনা করে শহীদ সাহেবের সাথে ফোনে আলাপ করতে চেষ্টা করলাম, তিনি কথা বলতে পারলেন না। তার জামাতা আহমেদ সোলায়মান কথা বললেন, তার মারফতে তিনি জানিয়ে দিলেন তার কোনো আপত্তি নাই।
আমি আপত্তি করলাম, মওলানা সাহেবেরও মতামত প্রয়োজন, কারণ অনেক পানি এর মধ্যে ঘোলা করা হয়েছে। শহীদ সাহেব, ভাসানী সাহেব যদিও কয়েকজনের নাম পূর্বেই ঠিক করে রেখেছিলেন, তবু আবারও আলোচনা করে মতামত নেওয়া উচিত। এদিকে কৃষক শ্রমিক দল কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেবকে তাদের পার্টি থেকে মন্ত্রিত্ব দিতে রাজি নন। আমরা জানিয়ে দিলাম, দরকার হয় তিনি আমাদের দলের পক্ষ থেকে মন্ত্রী হবেন। সত্য কথা বলার জন্য তাকে আমরা শাস্তি পেতে দিতে রাজি নই। রাত এগারটায় হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করে দুইখানা জিপ গাড়ি নিয়ে আতাউর রহমান সাহেব, মোর্শেদ সাহেব, কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেব, আবদুল কাদের সর্দার ও আমি টাঙ্গাইলের পথে রওয়ানা করলাম। রাস্তা খুবই খারাপ, তখনকার দিনে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল পৌঁছাতে ছয় ঘণ্টা সময় লাগত। চারটা খেয়া পার হতে হত। আমরা খুব ভোরে টাঙ্গাইল পৌঁছালাম। মওলানা সাহেব আওয়ামী লীগ অফিসের দোতলায় আছেন। আমরা তার সাথে পরামর্শ করলাম। তিনি খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন। পরে মোর্শেদ সাহেবের ওকালতিতে তিনি রাজি হলেন। আতাউর রহমান সাহেব তাকে নামগুলি দেখালেন। আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, হাশিমউদ্দিন আহমদ ও আমি। কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেব সম্বন্ধে তারা যখন আপত্তি করছে তখন তিনিও আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে মন্ত্রী হবেন। হক সাহেব ছাড়া মোটমাট বারজন মন্ত্রী হবেন। পরে দেখা গেল, আরও কয়েকজন বেড়ে গেল রাতারাতি।
৮২.
১৯৫৪ সালের মে মাস। আমরা সকলে শপথ নিতে সকাল নয়টায় লাটভবনে উপস্থিত হলাম। আমাদের যখন মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়া শেষ হল, ঠিক সেই সময় খবর এল আদমজী জুট মিলে বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে ভীষণ দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়েছে। ভোররাত থেকে সৈয়দ আজিজুল হক সেখানে উপস্থিত আছেন। রাতেই ইপিআর ফোর্স ও পুলিশ বাহিনী সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকার দু’একজন বড় সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের কর্মচারীরাও উপস্থিত আছেন। আমরা যখন শপথ নিচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে দাঙ্গা শুরু হওয়ার কারণ কি? বুঝতে বাকি রইল না, এ এক অশুভ লক্ষণ! হক সাহেব আমাদের নিয়ে সোজা রওয়ানা করলেন আদমজী জুট মিলে। তখন নারায়ণগঞ্জ হয়ে লঞ্চে যেতে হত। সোজা রাস্তা হয়েছে, তবে গাড়ি তখনও ভালভাবে চলতে পারে না। ট্রাক ও জিপ কষ্ট করে যেতে পারে। সকলেই রওয়ানা হয়ে গেছেন। আমাকে লাভবনের সামনে জনতা ঘিরে ফেলল এবং আমাকে নিয়ে শোভাযাত্রা তারা করবে বলে ঠিক করেছে। তাদের বুঝিয়ে বিদায় নিতে আধ ঘন্টার মত দেরি হয়ে গেল।
নারায়ণগঞ্জ যেয়ে শুনলাম, হক সাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করে ঢাকা রওয়ানা হয়ে গেছেন। একটা লঞ্চ রেখে গেছেন। আমি পৌঁছালাম এবং সাথে সাথে যেখানে দাঙ্গা তখনও চলছিল সেখানে উপস্থিত হলাম। আমাকে একটা পুলিশের জিপে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দাঙ্গা তখন অল্প অল্প চলছিল। যেদিকে যাই দেখি রাস্তায় রাস্তায় বস্তিতে বস্তিতে মরা মানুষের লাশ পড়ে আছে। অনেকগুলি আহত লোক চিৎকার করছে, সাহায্য করার কেউই নাই। ইপিআর পাহারা দিতেছে, বাঙালি ও অবাঙালিদের আলাদা আলাদা করে দিয়েছে। গ্রাম থেকে খবর পেয়ে হাজার হাজার বাঙালি এগিয়ে আসছে। অবাঙালিদের ট্রাকে করে মিলের বাইরে থেকে মিলের ভিতরে নিতেছে। আমার বড় অসহায় মনে হল। আমার সাথে মাত্র দুইজন আর্মড পুলিশ। এই সময় আরও কয়েকজন পুলিশের সাথে আমার দেখা হল। তাদের কাছে আসতে হুকুম দিলাম। এক গাছতলায় আমি আস্তানা পাতলাম। মিলের চারটা ট্রাক আছে, একটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু সংখ্যক লোক পাওয়া গেল, তাদের সাহায্যে যারা মরে গেছে তাদের রেখে আহত লোকগুলিকে এক জায়গায় করে পানি দিতে শুরু করলাম। আমার দেখাদেখি কয়েকজন কর্মচারীও কাজে হাত দিল। এই সময় মোহন মিয়া সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। আমার মনে বল এল। তিনটা ট্রাক হাজির করা হল। ড্রাইভাররা ভাগতে চেষ্টা করছিল। আমি হুকুম দিলাম, ভাগতে চেষ্টা করলেই গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দিব। আমার মেজাজ দেখে তারা ভয় পেয়ে গেল। ঢাকায় টেলিফোন করা হয়েছে, এ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার জন্য। মোহন মিয়া ও আমি সকাল এগারটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিনশতের মত আহত লোককে হাসপাতালে পাঠাতে পেরেছিলাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে যে সমস্ত বাঙালি জনসাধারণ জমা হচ্ছিল মিল আক্রমণ করার জন্য তাদের কাছে গিয়ে আমি বক্তৃতা করে তাদের শান্ত করলাম। তারা আমার কথা শুনল। যদি তারা সঠিক খবর পেত তাহা হলে আমার কথা শুনত কি না সন্দেহ ছিল। সন্ধ্যার একটু পূর্বে আমি সমস্ত এলাকা ঘুরে মৃত লাশের হিসাব করলাম একটা একটা করে গণনা করে, তাতে পাঁচশতের উপর লাশ আমি স্বচক্ষে দেখলাম। আরও শ’খানেক পুকুরের মধ্যে আছে, তাতে সন্দেহ নাই।