আমি শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে বললাম, আমাকে নিয়ে গোলমাল করার প্রয়োজন নাই। আমি মন্ত্রী হতে চাই না। আমাকে বাদ দিলে যদি পুরা মন্ত্রিত্ব গঠন করতে রাজি হয়, আপনারা তাই করেন। আমরা বসে আলাপ করছি, প্রায় এক ঘণ্টা পরে হক সাহেব খবর পাঠিয়েছেন, তিনি ছয়জনকে নিয়ে মন্ত্রিত্ব গঠন করতে চান এবং মুজিবকেও নিতে রাজি আছেন। ভাসানী সাহেব বলে দিলেন, “আওয়ামী লীগ যখন যোগদান করবে, আওয়ামী লীগের সব কয়জনই একসাথে যোগদান করবেন। এভাবে ভাঙা ভাঙাভাবে যোগদান করবে না।” পরদিন হক সাহেব শপথ গ্রহণ করলেন। আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া (কেএসপি) এবং আশরাফউদ্দিন চৌধুরী (নেজামে ইসলাম) শপথ গ্রহণ করলেন। লাভবনের সামনে এক বিক্ষোভ মিছিল হল, স্বজনপ্রীতি চলবে না’, ‘কোটারি চলবে না’, এমনি নানা রকমের স্লোগান। যদি একসাথে পুরা মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করত তা হলে লক্ষ লক্ষ লোক অভিনন্দন জানাত। মনে হল, একদিনের মধ্যে গণজাগরণ নষ্ট হয়ে গেছে। জনসাধারণ ঝিমিয়ে পড়েছে। হক সাহেবের দলবল বলতে শুরু করল, “এ সমস্ত শেখ মুজিবের কাজ।” সত্য কথা বলতে কি, আমি কিছুই জানতাম না। সব খবরের কাগজ পড়ে দেখেছি জনগণ ক্ষেপে যাচ্ছিল এবং যারা সংবর্ধনা দিতে গিয়েছিল তারাই উল্টা স্লোগান দিয়েছিল নান্না মিয়াকে মন্ত্রী করার জন্য। কারণ, তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন না। তার একমাত্র পরিচয় লোকে জানত, হক সাহেবের ভাগিনেয়। লোক হিসাবে সৈয়দ আজিজুল হক অমায়িক ও ভদ্র। আমার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্বন্ধ খুবই মধুর ছিল। কলকাতা থেকে তাকে আমি জানতাম। কোনোদিন তাকে আমি রাগ হতে দেখি নাই। যাহোক, হক সাহেব এই সমস্ত কাজ নিজে কিছুই করেন নাই। বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অন্যের কথা শুনতেন, বিশেষ করে লীগ থেকে বিতাড়িত দলের, যার নেতত্ব করতেন ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) সাহেব। তিনি নিজে মন্ত্রী হতে চান। তিনি জীবনভর মন্ত্রিত্ব ভাঙছেন আর গড়েছেন। তার একটা বিশেষ অসুবিধা হল তিনি লেখাপড়া ভাল জানতেন না, তাই কেউই তার নাম বলেন না। কর্মী হিসাবে তার মত কর্মী এ দেশে খুব কম জন্মগ্রহণ করেছেন। রাতদিন সমানভাবে পরিশ্রম করতে পারতেন। তাঁকে অনেকে Evil Genius বলে থাকেন। যদি ভাল কাজে তার বুদ্ধি ও কর্মশক্তি ব্যবহার করতেন তাহলে সত্যিকারের দেশের কাজ করতে পারতেন।
৮১-৯০. মন্ত্রিসভায় যোগদান না করে
আমরা মন্ত্রিসভায় যোগদান না করে পার্টি গঠনের কাজে মন দিলাম। শহীদ সাহেব করাচিতে ফিরে গেলেন। তার স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে পড়েছে অত্যধিক পরিশ্রমে। হক সাহেব করাচিতে বেড়াতে গেলে কেন্দ্রীয় গণপরিষদের পূর্ব বাংলার সদস্যরা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তারা পদত্যাগ করবেন কি না, তিনি তার উত্তরে বলেছিলেন, তিনি নিজেই পদত্যাগ করেন নাই, আর তাদের করতে হবে কেন?” যদিও যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পাটির প্রথম সভায় দ্বিতীয় প্রস্তাবে তাদের পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল। করাচিতে মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ নেতারা তাঁর সাথে যোগাযোগ করে তাকে জানিয়ে দিল, তাঁদের রাগ আওয়ামী লীগারদের বিরুদ্ধে; হক সাহেবকে তাঁরা সমর্থন করবেন এবং যাতে তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারেন তার চেষ্টা করবেন। শুধু আওয়ামী লীগকে যেন দূরে সরিয়ে রাখেন। গোপনে গোপনে আওয়ামী লীগ থেকে সদস্য ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছিল, কিন্তু উপায় ছিল না। কেউই দলত্যাগ করতে রাজি না। যাদের মনের মধ্যে মন্ত্রিত্বের খায়েশ ছিল তারাও জনমতের ভয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। হক সাহেবকে তার দলবল ধোকা দিয়েই চলেছে। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বলতা পেলেই যে ঝাঁপিয়ে পড়বে এ সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল না, কারণ তারা জানত আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়া সরকার চলতে পারে না। সংসদ সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগুরু। সকল দল মিলেও আওয়ামী লীগের সমান হতে পারবে না।
করাচি হতে ফিরবার পথে হক সাহেব কলকাতায় দু’একদিনের জন্য ছিলেন। সেখানে তার বক্তৃতা বলে কথিত কয়েকটা সংবাদ সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপানো হয়েছিল।৭ সুযোগ বুঝে মোহাম্মদ আলী বগুড়া ও তার দলবলেরা হক সাহেবের বিরুদ্ধে তাই নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। হক সাহেব মহাবিপদে পড়লেন। এই বিপদের মুহুর্তে আওয়ামী লীগ নেতা বা কর্মীরা হক সাহেব ও তার দলবলের বিরুদ্ধাচরণ করলেন না। তারা জানিয়ে দিলেন যে, তারা হক মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করবেন। হক সাহেব এই অবস্থায় আওয়ামী লীগারদের সাথে আলোচনা করে পুরা মন্ত্রিসভা গঠন করতে আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলেন। এই সময় হক সাহেবের আর এক ভাগিনেয় জনাব মাহবুব মোর্শেদ বার এট ল (পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হন) হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করে আতাউর রহমান খান ও মানিক মিয়াকে অনুরোধ করলেন যাতে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় যোগদান করে। তাকে সাহায্য করছিলেন ঢাকার কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেব ও মির্জা আবদুল কাদের সর্দার। শহীদ সাহেব তখন করাচিতে ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তার পক্ষে ঢাকায় আসা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
আমি ও মওলানা সাহেব জনসভা করতে মফস্বলে বের হয়ে গেছি। আমাদের প্রোগ্রাম জানা ছিল অফিসের। হক সাহেব আতাউর রহমান খান ও মানিক ভাইকে বলেছেন যে, আমাকে মন্ত্রী করতে চান। মওলানা সাহেব ও আমি টাঙ্গাইলে এক কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতা করছিলাম। এই সময় টাঙ্গাইলের এসডিও একটা রেডিওগ্রাম নিয়ে সভায় হাজির হলেন। আমাকে জানালেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে ঢাকায় যেতে অনুরোধ করে রেডিওগ্রাম পাঠিয়েছেন। আমি মওলানা সাহেবের সাথে পরামর্শ করলাম। মওলানা সাহেব বললেন, “দরকার হলে তোমাকে মন্ত্রিসভায় যোগদান করতে হবে। তবে শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে নিও—এ সময় এইভাবে মন্ত্রিত্বে যাওয়া উচিত হবে কি না? বোধহয় হক সাহেবের দল কোনো মুশকিলে পড়েছে, তাই ডাক পড়েছে।“