৮০.
নির্বাচনের ফলাফল বের হওয়ার পরে আমি ঢাকা আসলাম। আমাকে রেলস্টেশনে বিরাটভাবে অভ্যর্থনা করা হয়েছিল। শোভাযাত্রা করে আমাকে আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে আসা হল। শহীদ সাহেব আমার জন্য চিন্তায় ছিলেন। যদিও আমার গ্রামের বাড়িতে বসে আমাকে বলে এসেছিলেন, “তোমার চিন্তার কোনো কারণ নাই, আমি যা দেখলাম তাতে তোমার জয় সুনিশ্চিত।”
তাড়াতাড়ি যুক্তফ্রন্টের এমএলএদের সভা ডাকা হল, ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে। আওয়ামী লীগ দলীয় এমএলএদের সভা ডাকা হল আওয়ামী লীগ অফিসে ঐ একই দিন সকালবেলা। নির্বাচনে জয় লাভ করার সাথে সাথে আমাদের কানে আসতে লাগল জনাব মোহাম্মদ আলী বগুড়া হক সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করছেন, পুরানা মুসলিম লীগারদের মারফতে—যারা কিছুদিন পূর্বে হক সাহেবের দলে যোগদান করে এমএলএ হয়েছেন কৃষক শ্রমিক দলের নামে। আদতে তারা মনে প্রাণে মুসলিম লীগ। সকালবেলা আওয়ামী লীগ সদস্যদের সভা আর বিকালে বার লাইব্রেরি হলে সমস্ত দল মিলে যুক্তফ্রন্ট এমএলএদের সভা। আওয়ামী লীগের সভায় শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব উপস্থিত ছিলেন। সভায় রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতা খয়রাত হোসেন সাহেব প্রস্তাবের মারফতে বললেন, “জনাব এ, কে, ফজলুল হক সাহেবকে নেতা নির্বাচন করার পূর্বে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তার সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রীদের লিস্ট ফয়সালা করা উচিত। একবার তাকে যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি দলের নেতা করলে তার দলবলের মধ্যে এমন সমস্ত পাকা খেলোয়াড় আছে, যারা চক্রান্তের খেলা শুরু করতে পারে। আর একজন ডেপুটি লিডার আমাদের দল থেকে করা উচিত, কারণ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যুক্তফ্রন্টের মধ্যে।” শহীদ সাহেব বললেন, “তিনি নিশ্চয়ই আমাদের দুইজনের সাথে পরামর্শ করবেন, মন্ত্রীদের নাম ঠিক করার পূর্বে। বৃদ্ধ মানুষ এখন তাঁকে আর বিরক্ত করা উচিত হবে না।” ভাসানী সাহেবও শহীদ সাহেবকে সমর্থন করলেন। আমি জনাব খয়রাত হোসেনের সাথে একমত ছিলাম। কিন্তু এই নিয়ে আর জোর করলাম না। আমি যখন আমার বাড়ি টুঙ্গিপাড়া থেকে নির্বাচনের পরে ফিরে আসি, শহীদ সাহেব আমাকে একাকী ডেকে বললেন, “তুমি মন্ত্রিত্ব নেবা কি না?” আমি বললাম, “আমি মন্ত্রিত্ব চাই না। পার্টির অনেক কাজ আছে, বহু প্রার্থী আছে দেখে শুনে তাদের করে দেন। শহীদ সাহেব আর কিছুই আমাকে বলেন নাই।।
ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে যুক্তফ্রন্ট এমএলএদের সভা হল। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তাতে উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় এ, কে, ফজলুল হক সাহেবকে সর্বসম্মতিক্রমে নেতা করা হল। আর দ্বিতীয় প্রস্তাবে মুসলিম লীগ দলীয় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য, যারা পুরানা প্রাদেশিক আইনসভার মারফতে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন তাদের পদত্যাগ দাবি করা হল। হক সাহেব নেতা নির্বাচিত হওয়ার কিছু সময় পরেই পূর্ব বাংলার গভর্নর তাঁকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহ্বান করলেন। তিনি রাজি হয়ে এসে, শীঘ্রই মন্ত্রিসভার নাম পেশ করবেন বলে বাড়িতে ফিরে গেলেন। সেইদিন সন্ধ্যার পরে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তার সঙ্গে আলোচনা করতে গেলেন। আমিও সাথে ছিলাম। তিন নেতা আলোচনায় বসলেন, এক আলাদা ঘরে। বাইরে থেকে কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতাদের হাবভাব দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। চারিদিকে একটা ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে হল। কিছু সময় পরে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব বের হয়ে আসলেন এবং সোজা ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে পৌঁছালেন। আতাউর রহমান সাহেবও উপস্থিত হলেন। তাঁরা আমাদের জানালেন, হক সাহেব এখন মাত্র চার পাঁচজন মন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন; কিছুদিন পরে আরও কিছু সংখ্যক মন্ত্রী নিবেন। এখন আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া), আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, আতাউর রহমান খান ও আবদুস সালাম খানকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে চান। আমাদের নেতারা তাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, পুরা টিম নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত। জনগণের আশা আকাক্ষা হল, যুক্তফ্রন্ট তাড়াতাড়ি দেশের জন্য কাজ শুরু করবেন। তারা আরও আপত্তি করলেন, এখন নান্না মিয়াকে না নিয়ে পরে নিলেই ভাল হয়। আর যদি পুরা টিম নিয়ে মন্ত্রিত্ব গঠন করেন তবে তাকে এখনই নিতে আপত্তি নাই। তারা বিশেষ করে জোর দিলেন পুরা টিম নিতে। হক সাহেব রাজি না হওয়াতে তাঁরা তাঁকে বলে এসেছেন, আওয়ামী লীগের কেউই এভাবে মন্ত্রিত্বে যেতে পারে না। আপনি আপনার দল নিয়ে মন্ত্রিত্ব গঠন করেন। আওয়ামী লীগ আপনার মন্ত্রিসভাকে সমর্থন দিবে এবং যখন পুরা মন্ত্রিত্ব গঠন করবেন তখন আওয়ামী লীগ তাতে যোগদান করবে। আওয়ামী লীগের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টির এক ষড়যন্ত্র হচ্ছে এটা বুঝতে আর নেতাদের বাকি রইল না।
হক সাহেব শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে বলেছেন, “আমি শেখ মুজিবকে আমার মন্ত্রিত্বে নিব না।” তার উত্তরে শহীদ সাহেব বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগের কাকে নেওয়া হবে না হবে সেটা তো আমি ও ভাসানী সাহেব ঠিক করব; আপনি যখন বলছেন নান্না মিয়াকে ছাড়া আপনার চলে না, তখন আমরাও তো বলতে পারি শেখ মুজিবকে ছাড়া আমাদের চলে না। সে আমাদের দলের সেক্রেটারি। মুজিব তো মন্ত্রিত্বের প্রার্থী না। এ সকল কথা বললে পার্টি থেকে বলতে পারে।”