নির্বাচনে দেখা গেল ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় দশ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছেন। জনসাধারণ আমাকে শুধু ভোটই দেয় নাই, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা নজরানা হিসাবে দিয়েছিল নির্বাচনে খরচ চালানোর জন্য। আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে। মওলানা শামসুল হক সাহেব পরে তার ভুল বুঝতে পেরে সক্রিয় রাজনীতি হতে সরে পড়েছিলেন। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে শহীদ সাহেব বিবৃতির মারফতে বলেছিলেন, মুসলিম লীগ নয়টির বেশি সিট পেলে আমি আশ্চর্য হব। তিনশতের মধ্যে মুসলিম লীগ নয়টা আসনই পেয়েছিল।২৬
দুনিয়ার ইতিহাসে একটা ক্ষমতাসীন দলের এভাবে পরাজয়ের খবর কোনোদিন শোনা যায় নাই। বাঙালিরা রাজনীতির জ্ঞান রাখে এবং রাজনৈতিক চেতনাশীল। এবারও তারা তার প্রমাণ দিল। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুর উপর সাধারণ নির্বাচনেও তারা তা প্রমাণ করেছিল। এবারের নির্বাচনে মুসলিম লীগের অনেক বড় বড় এবং হোমরাচোমরা নেতারা, এদের মধ্যে অনেকেই আবার কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন, যারা শুধু পরাজিত হন। নাই, তাদের জামানতের টাকাও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এমনকি পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমিনও পরাজিত হন। এতে শাসকগোষ্ঠী, শোষকগোষ্ঠী এবং আমলারা অনেকেই ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তবু আশা ছাড়েন নাই। তারা চক্রান্তমূলক নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করতে চেষ্টা করতে লাগলেন—বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা-যারা পূর্ব বাংলায় কারখানা ও ব্যবসা পেতে বসেছেন এবং যথেষ্ট টাকাও মুসলিম লীগকে প্রকাশ্যভাবে দিয়ে সাহায্য করেছেন তারা ভয়ানক অসুবিধায় পড়ে গেলেন। তাঁরা জানেন, তাঁদের পিছনে দাঁড়াবার জন্য এখনও কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম লীগের হাতে আছে। যারা পরাজিত হলেন তারা গণতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্বাস কোনোদিন করতেন না, তাই জনগণের এই রায় মেনে নিলেন না। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আরম্ভ করলেন। পূর্ব বাংলা ছেড়ে সকলেই প্রায় করাচিতে আশ্রয় নিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, শিল্পপতিরা ও আমলারা এদের বিপর্যয়ে খুবই ব্যথা পেলেন, কারণ এ রকম সুবোধ বালক’ তারা কি আর ভবিষ্যতে পাবেন; যাঁরা পূর্ব বাংলার সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে দিয়ে দেবেন, একটু প্রতিবাদও করবেন না! শুধু একটা জিনিস তাঁরা পেলেই সম্রষ্ট থাকেন, মন্ত্রিত্ব’ এবং ক্ষমতার একটু ভাগ। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল জানেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের জন্য জনমত সৃষ্টি করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে—চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মিলিটারিতে বাঙালিদের স্থান দেওয়া হচ্ছে না—এ সম্বন্ধে আওয়ামী লীগ সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে কতগুলি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করেছে সমস্ত দেশে। সমস্ত পূর্ব বাংলায় গানের মারফতে গ্রাম্য লোক কবিরা প্রচারে নেমেছেন।
এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ স্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। মুসলিম লীগ নেতারা এসব বিষয়ে কোনো সুষ্ট প্রোগ্রাম জনগণের সামনে পেশ না করে বলে চলেছে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে, মুসলিম লীগ পাকিস্তান কায়েম করেছে, তাই মুসলিম লীগ পাকিস্তানের মাতা, পাকিস্তান অর্থ মুসলিম লীগ ইত্যাদি। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য নেতারা রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দুদের দালাল, পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা এক করতে চায়’—এ রকম নানা রকমের শ্লোগান দিতে আরম্ভ করেছিল। জনগণ শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে জানত যে তিনি পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হককে জানত, তিনি এদেশের মানুষকে ভালবাসতেন এবং মওলানা ভাসানীও পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছেন। আর আমরা যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছি তাও জনগণের জানা ছিল, তাই ধোকায় কাজ হল না।
একুশ দফা দাবি জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য পেশ করা হয়েছে। তা জনগণ বুঝতে পেরেছে। কারণ, আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সাল থেকে বাংলাদেশে এর অনেকগুলো দাবি প্রচার করেছে। ইলেকশনের কিছুদিন পূর্বে এক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হয়েছিল। চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী কাগজের কারখানায় বাঙালিরা প্রায় সকলেই শ্রমিক, আর অবাঙালিরা বড় বড় কর্মচারী। তাদের ব্যবহারও ভাল ছিল না। মুসলিম লীগ নেতারা প্রচার করেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে অবাঙালিদের পূর্ব বাংলায় থাকতে দেবে না।
আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনোদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান। শোষক শ্ৰেণীকে তারা পছন্দ করে না। পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ রকম অপপ্রচার করা হয়েছে।