আমার মতের বিরুদ্ধে হলেও যখন নেতারা ভাল বুঝে এটা করেছেন তাতে দেশের ভালই হতে পারে। আমি চেষ্টা করতে লাগলাম যাতে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে যুক্তফ্রন্ট চলে। দুই দিন না যেতেই প্রথম খেলা শুরু হল। নামও শুনি নাই এমন দলের আবির্ভাব হল। হক সাহেব খবর দিলেন, নেজামে ইসলাম পার্টি’ নামে একটা পার্টির সাথে পূর্বেই তিনি দস্তখত করেছেন। তাদেরও যুক্তফ্রন্টে নিতে হবে। আমি মওলানা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “আমি তো কিছুই জানি না।” আমি বললাম, “ঐ পার্টি কোথায়, এর প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি কারা? সংগঠন কোথায় যে এদের নিতে হবে? এদের নিলে ‘গণতান্ত্রিক দল’ বলে যে একটা দল কাগজের মারফতে দু’একবার দেখেছি তাদেরও নিতে হবে। এদের মধ্যে তবু দুই চারজন প্রগতিশীল কর্মীও আছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে অনেকে গণতান্ত্রিক দলকে নেওয়া হয়, তা চায় না।”
শহীদ সাহেব এসে অফিস ঠিক করলেন। তাঁকে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান করতে কেউই আপত্তি করল না। আওয়ামী লীগ থেকে আতাউর রহমান খান ও কৃষক শ্রমিক পার্টি হতে কফিলুদ্দিন চৌধুরী জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং কামরুদ্দিন আহমদকে অফিস সেক্রেটারি করা হল। একটা স্টিয়ারিং কমিটিও করা হল। তিন পার্টির সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে বোর্ড করা হল, যারা নমিনেশন দিবেন। শহীদ সাহেবকে চেয়ারম্যান করা হল, আর ঠিক হল সর্বসম্মতিক্রমে নমিনেশন দিতে হবে। কোন রকম ভোটাভুটি হবে না। শহীদ সাহেব কার্যাবলি ঠিক করে ফেললেন রাতদিন পরিশ্রম করে। তিনি অফিসের ভিতরেই একটা কামরায় থাকার বন্দোবস্ত করলেন। রাতদিন সেখানেই থেকে সকল কিছু ঠিকঠাক করে কাজ শুরু করলেন। নমিনেশনের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হল। ফর্ম ছাপিয়ে দেওয়া হল, তাতে প্রার্থী কোন পার্টির সদস্য তাও লেখা থাকবে এবং পার্টিকে কপি দিতে হবে। শহীদ সাহেব টাকা পয়সার অভাব অনুভব করতে লাগলেন।
যারা নমিনেশন পাওয়ার জন্য দরখাস্ত করবেন তাদের একটা ফি জমা দিতে হবে। নমিনেশন না দিলেও ঐ টাকা ফেরত দেওয়া হবে না। যত লোক নমিনেশনের জন্য দরখাস্ত করেছিল তাতে প্রায় এক লক্ষ টাকার মত জমা পড়েছিল। শহীদ সাহেব নিজে কয়েকটা মাইক্রোফোন জোগাড় করে এনেছিলেন। আমাদের যানবাহন বলতে কিছুই ছিল না। শহীদ সাহেব একটা পুরানা জিপ কিনেছিলেন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অভাব ছিল না। প্রত্যেকটা নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছিল, যারা ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নিজ নিজ এলাকায় কাজ করেছে। হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক দলের প্রার্থীর অভাব থাকায় বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা থেকে যারাই ইলেকশন করতে আশা করে তারাই কৃষক শ্রমিক দলে নাম লিখিয়ে দরখাস্ত করেছিল। কোনোদিন রাজনীতি করে নাই, অথবা রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিল অথবা মুসলিম লীগের সভ্য আছে তারা নমিনেশন পাবে না। কিন্তু এমন প্রমাণও আছে প্রথমে মুসলিম লীগে দরখাস্ত করেছে, নমিনেশন না পেয়ে কৃষক শ্রমিক দলে নাম লিখিয়ে নমিনেশন পেয়েছে।
অনেক প্রার্থী—যারা জেল খেটেছে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তাদের নমিনেশন দেওয়া যায় নাই; যেমন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সম্পাদক এম. এ. আজিজকে নমিনেশন দেওয়া যায় নাই। তার পরিবর্তে একজন ব্যবসায়ীকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল। খোন্দকার মোশতাক আহমদের মত জেলখাটা কর্মীকেও নমিনেশন দেওয়া হয় নাই। নোয়াখালীর আবদুল জব্বার খদ্দর প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগ করেছেন, তাঁকেও বাদ দিতে হয়েছিল। নেজামে ইসলাম দল কয়েকজন মওলানা সাহেবের নাম নিয়ে এসেছে, তারা দরখাস্তও করে নাই। তাদের সব কয়জনকে নমিনেশন দিতে হবে। এই দল একুশ দফায় দস্তখতও করে নাই। তবে এই দলের প্রতিনিধি একটা লিষ্ট দাখিল করলেন, যাদের নমিনেশন দেওয়া যাবে না। কারণ তারা সকলেই নাকি কমিউনিস্ট। এরা কিছু আওয়ামী লীগের জেলখাটা সদস্য আর কিছু কিছু গণতান্ত্রিক দলের সদস্য। এর প্রতিবাদে আমি বললাম, “আমারও একটা লিস্ট আছে, তাদের নমিনেশন দেওয়া হবে না, কারণ এরা পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছে।”
এদের দাবি এমন পর্যায়ে চলে গেল যে নিঃস্বার্থ কর্মী ও নেতাদের নমিনেশন না দিয়ে যারা মাত্র চার-পাঁচ মাস পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম লীগ করেছে অথবা জীবনে রাজনীতি করে নাই, তাদেরই নমিনেশন দিতে হবে। মাঝে মাঝে হক সাহেবের কাছ থেকে ছোট্ট ছোট্ট চিঠিও এসে হাজির হয়। তার চিঠিকে সম্মান না করে পারা যায় না। আবার কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলামের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা সভা ছেড়ে উঠে চলে যায়, হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করার কথা বলে। এইভাবে চলতে লাগল। মওলানা ভাসানী সাহেবকে অনেক কষ্ট করে ঢাকায় আনলাম। তিনি এসেই আবার বাইরে চলে যেতে চাইলেন। আমরা তাঁকে সব কথা বললাম। তিনি উত্তর দিলেন, “ঐ সমস্ত লোকের সাথে কি করে কাজ করা যায়, আমি এর ধার ধারি না। তোমাদের যুক্তফ্রন্ট মানি না। আমি চললাম। আমার সাথে খুবই কথা কাটাকাটি হল। তাকে বললাম, “নমিনেশন নিয়ে আলোচনার সময় অন্য দলের লোকেরা আলোচনা করতে চলে যায় হক সাহেবের কাছে, আর আমরা কোথায় যাই? শহীদ সাহেব তো চেয়ারম্যান, তিনি তো পক্ষ অবলম্বন করতে পারেন না। আপনি ঢাকায় থাকেন, আগামীকাল শহীদ সাহেবের সাথে আপনার আলোচনা হওয়া দরকার।” তিনি চুপ করে রইলেন। আমাকে তাড়াতাড়ি সভায় যেতে হবে। আতাউর রহমান সাহেবও চুপ করে থাকেন। আমাকেই সকল সময় তর্ক বিতর্ক করতে হয়। প্রত্যেকটা প্রার্থীর খবরাখবর নিতে হয়। কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেব কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য হলেও তার দলের নেতাদের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের ভাল প্রার্থী হলে তাকে সমর্থন করতেন। তাই তার উপরে ক্ষেপে গিয়েছে তার দলের লোকেরা। আতাউর রহমান সাহেবও ক্ষেপে যেয়ে অনেক সময় বলতেন, “এদের সাথে কথা বলতে আমার ঘৃণা করে।”