শহীদ সাহেবও সভা করতে আরম্ভ করলেন। তিনি জানতেন, যুক্তফ্রন্ট হলে কি হবে! অতটা ব্যস্ত তিনি ছিলেন না। একদিন শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব আলাপ করছিলেন, আমিও তাদের সাথে ছিলাম। এ সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমি বলেছিলাম, “ইলেকশন এলায়েন্স করলে করা যেতে পারে। যেখানে হক সাহেবের দলের ভাল লোক থাকবে, সেখানে আওয়ামী লীগ নমিনেশন দিবে না। আর যেখানে আওয়ামী লীগের ভাল নমিনি থাকবে সেখানে তারা নমিনেশন দিবেন না। যার যার পার্টির প্রোগ্রাম নিয়ে ইলেকশন করবে।” ভাসানী সাহেব তাতেও রাজি নন। তিনি বললেন, “আওয়ামী লীগ এককভাবে ইলেকশন লড়বে।“ আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে বললেন। ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাস হবে, শহীদ সাহেব ভাসানী সাহেব ও আমাকে বললেন, করাচি যেতে হবে কয়েকদিনের জন্য কিছু টাকার জোগাড় করতে হবে। এবার ফিরে এসে আর পশ্চিম পাকিস্তানে যাবেন না ইলেকশন শেষ না করে—তাও বললেন।
মওলানা সাহেব ও আমি জেলায় জেলায় সভা করতে বের হয়ে গেলাম। শহীদ সাহেব যেদিন ঢাকা আসবেন তার দু’একদিন পূর্বে আমরা ঢাকায় পৌঁছাব। এবার আমরা উত্তরবঙ্গ সফরে রওয়ানা করলাম। উত্তরবঙ্গ সফর শেষ করে কুষ্টিয়া জেলায় তিনটা সভা করে। ঢাকায় পৌঁছাব। খুবই ভাল সাড়া পেলাম। কোথায় কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে সে বিষয়ে সুপারিশ করার জন্য জেলা কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিলাম। তারা নাম ঠিক করে আমাকে জানাবে। যাদের জেলা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সুপারিশ করবে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। যেখানে একমত হতে পারবে না, সেখানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনীত করবে। তবে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব একমত হয়ে যাকে ইচ্ছা তাকে নমিনেশন দিতে পারবেন। যেদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কুষ্টিয়া পৌঁছালাম সেইদিনই টেলিগ্রাম পেলাম, আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক মিয়া আমাদের দুইজনকে ঢাকায় যেতে অনুরোধ করেছেন। আমি রাতে আতাউর রহমান খান সাহেবের কাছে টেলিফোন করলাম কুষ্টিয়া থেকে। তিনি জানালেন, সভা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসতে। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, আগামীকাল সভা, এখন বন্ধ করলে কর্মীরা মার খাবে। পার্টির অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। খান সাহেব পীড়াপীড়ি করলেন। তখন আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, মওলানা সাহেবকে পাঠিয়ে দিতেছি আজ, আমি সভাগুলিতে বক্তৃতা করে তিন দিন পরেই পৌঁছাব। তিনি রাজি হলেন। আতাউর রহমান সাহেবও আমাদের সাথে প্রথমে একমত ছিলেন যে, যুক্তফ্রন্ট করা উচিত হবে না। দুঃখের বিষয়, তাঁর নিজের কোনো মতামত বেশি সময় ঠিক থাকে না। যে যা বলে, তাতেই তিনি হ্যাঁ, হ্যা করেন। এক কথায়, “তার হাত ধরলে, তিনি না বলতে পারেন না। মওলানা সাহেব ঢাকায় রওয়ানা করে গেলেন। আমি মিটিংগুলি শেষ করে রওয়ানা হব। এমন সময় খবর পেলাম, হক সাহেব ও মওলানা ভাসানী দস্তখত করে যুক্তফ্রন্ট করে ফেলেছেন।
আমি বুঝতে পারলাম না, ভাসানী সাহেব কি করে দস্তখত করলেন! শহীদ সাহেবের অনুপস্থিতিতে কি প্রোগ্রাম হবে? সংগঠনের কি হবে? নমিনেশন কোন পদ্ধতিতে দেওয়া হবে? কেনই বা মওলানা সাহেব এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন? কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঢাকায় ফিরে এসে ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে মওলানা সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলাম। নিচের কামরায় আওয়ামী লীগের অফিস। অফিসে যেয়ে যখন বসেছি, তখন কর্মীরা আমায় খবর দিল, কিভাবে কি হয়েছে। আবুল মনসুর আহমদ সাহেব বিচক্ষণ লোক সন্দেহ নাই। তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন এবং তাড়াতাড়ি কফিলুদ্দিন চৌধুরীর সাহায্যে একুশ দফা প্রোগ্রামে দস্তখত করিয়ে নিলেন হক সাহেবকে দিয়ে। তাতে আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা, রাজবন্দিদের মুক্তি এবং আরও কতকগুলি মূল দাবি মেনে নেওয়া হল। আমরা যারা এদেশের রাজনীতির সাথে জড়িত আছি তারা জানি, এই দস্তখতের কোনো অর্থ নাই অনেকের কাছে।
আমি মওলানা সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, “দেখ মুজিব, আমি যুক্তফ্রন্টে দস্তখত করতে আপত্তি করেছিলাম তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত; আতাউর রহমান ও মানিককে আমি বললাম যে, মুজিব সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের, তার সাথে পরামর্শ না করে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আতাউর রহমান ও মানিক বলল যে, তারা দুইজনে তোমার দায়িত্ব নিল। আমরা যা করব, মুজিব তা মেনে নেবে। তাই হক সাহেব যখন আমার কাছে এসে আমাকে অনুরোধ করলেন, তখন আমি দস্তখত করতে বাধ্য হলাম। আমি তাকে বললাম, “আমার কথা ছেড়ে দেন, শহীদ সাহেবের জন্য দুই দিন দেরি করলে কি অন্যায় হত? তিনি তো দুই তিন দিনের মধ্যে ঢাকায় আসবেন। পূর্বে আমাকে এক কথা বলেছেন, আজ করলেন তার উল্টা। আমাকে এগিয়ে দিয়ে নিজে দস্তখত করে বসলেন! কোন পন্থায় নমিনেশন হবে? কিভাবে কাজ চলবে? দায়িত্ব কে নিবে এই নির্বাচনের, কিছুই ঠিক না করে ঘোষণা করে দিলেন আমি আর হক সাহেব যুক্তফ্রন্ট করলাম!’ যা করেছেন ভালই করেছেন, আমি আর কি করব! আর যখন আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক ভাই আমার ভার নিয়েছেন দাবি করে, তখন তাদের কথা আমি ফেলি বা কেমন করে! এতে দেশের যদি মঙ্গল হয় ভাল। আর যদি ক্ষতি হয় আপনারাই দায়ী হবেন, আমি তো পার্টির সেক্রেটারি ছাড়া আর কিছুই না। আপনারা নেতা, যখন যুক্তফ্রন্ট করেছেন—এখন যাতে তা ভালভাবে চলে তার বন্দোবস্ত করুন।” মওলানা সাহেব বললেন, “আমি বলে দিয়েছি, শহীদ সাহেব এসে সকল কিছু ঠিক করবেন। নমিনেশন বা নিয়মকানুন যা করতে হয় তিনিই করবেন।”