আমি ভোর পাঁচটায় আবুল মনসুর আহমদ সাহেবকে এ বিষয়ে জানালাম এবং বললাম, “তাকে নিষেধ করবেন এ সমস্ত করতে। কারণ গোলমাল হলে লোকে মন্দ বলবে।” আবুল মনসুর সাহেব বললেন, “আমি তো কিছুই জানি না, তবে দেখব।” আমি সকালবেলায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলাম, এক একজন সেক্রেটারি এক একটা দরজায় থাকবে এবং তাদের প্রত্যেকের সাথে আটজন করে কম থাকবে। আমার দস্তখত করা কার্ড ছাড়া কাউকে ভিতরে যেতে দেওয়া হবে না। বিভিন্ন জেলা থেকে ভাল ভাল যুবক কর্মীদের গেটে থাকতে নির্দেশ দিলাম। ফল ভালই হল; বাইরের লোক কেউই ভেতরে যেতে পারল না। কেউ কেউ কয়েকবার চেষ্টা করেছে, লাভ হয় নাই। কর্মীদের মনোভাব দেখে আর অগ্রসর হতে সাহস পায় নাই। আমি সেক্রেটারির রিপোর্ট পেশ করলাম। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব বক্তৃতা করলেন। আমার যতদূর মনে হয় বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ পেয়ে মিয়া ইফতিখারউদ্দিন সভায় যোগদান করেছিলেন; শেষে তিনি বক্তৃতাও করলেন। বৈদেশিক নীতি ও যুক্তফ্রন্ট’ এই দুইটা বিষয় নিয়ে খুবই আলোচনা হল। সাবজেক্ট কমিটিও বসেছিল, কিন্তু কোনো মীমাংসা হল না। আমি কাউন্সিল সভায় বৈদেশিক নীতির উপর প্রস্তাব আনলাম। আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। আবদুস সালাম খান এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তৃতা করলেন এবং অতি প্রগতিবাদী বলে আমাকে আক্রমণ করলেন। আমি তাঁকে অতি প্রতিক্রিয়াশীল বলে। যখোপযুক্ত জবাব দিলাম। প্রস্তাব পাস হয়ে গেল, অবস্থা দেখে তিনি আর ভোটাভুটি চাইলেন না।
এর পরই শুরু হল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির ঐক্যফ্রন্ট করা হবে কি হবে না সেই বিতর্ক! ঐক্যফ্রন্ট সমর্থকরা প্রস্তাব আনলেন, আমি বিরোধিতা করে বক্তৃতা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য বিরোধী কোনো দল আছে কি না? যাদের নীতি ও আদর্শ নাই তাদের সাথে ঐক্যফ্রন্ট করার অর্থ হল কতকগুলি মরা লোককে বাঁচিয়ে তোলা। এরা অনেকেই দেশের ক্ষতি করেছে। রাজনীতি এরা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য করে, দেশের কথা ঘুমের ঘোরেও চিন্তা করে না। আমার বক্তৃতায় একটু ভাবপ্রবণতা ছিল। কারণ এদের মধ্যে অনেকে ১৯৪৮, ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনকে দমাবার জন্য সকল রকম চেষ্টা করেছে। লীগ সরকার আমাদের দিনের পর দিন কারাগারে বিনা বিচারে বন্দি করে রেখেছিল। ভাসানী সাহেবও ঐক্যফ্রন্টের খুব বিরোধী, শহীদ সাহেবও বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। ঐক্যবাদীরা একটু ঘাবড়িয়ে গেল। তবে আতাউর রহমান সাহেব ও আমি একমত, যুক্তফ্রন্ট চাই না’-এ প্রস্তাব হওয়া উচিত না। জনগণ মনে করবে আওয়ামী লীগই একতা চায় না। আমি আমার বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কি কারও কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন যে, গায়ে পড়ে প্রস্তাব করতে চান? যুক্তফ্রন্টের প্রস্তাব আসলে ভোটে পরাজিত হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত অবস্থা বিবেচনা করে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে ভার দেওয়া হল, তারা যা ভাল বিবেচনা করেন তাই করবেন। তবে দুইজনের একমত হতে হবে এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সাথে আলোচনা করবেন, যখন এ সম্বন্ধে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। আমার বন্ধুরা জানতেন, শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব দুইজনই ঐ সমস্ত লোকদের অনেককে পছন্দ করেন না। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন, যদি ফজলুল হক সাহেব আওয়ামী লীগে আসেন তাঁকে তারা মাথা পেতে গ্রহণ করবেন এবং পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী বানাবার চেষ্টা করবেন। পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতাও তিনি হবেন। শহীদ সাহেব আমাকে বলেছিলেন, “বৃদ্ধ নেতা, বহু কাজ করেছেন জীবনে, শেষ বয়সে তাঁকে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত দেশ সেবা করতে।”।
মওলানা ভাসানী আমাকে বলে দিলেন, তিনি যুক্তফ্রন্ট করবেন না। হামিদুল হক চৌধুরী ও মোহন মিয়ার সাথে একসাথে রাজনীতি করার কোনো কথাই ওঠে না। নূরুল আমিন সাহেব যে দোষে দোষী এরাও সেই দোষেই দোষী। আমাকে নির্বাচন অফিস করা এবং কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে সে সকল বিষয়ে সবকিছু ঠিক করার জন্য নির্দেশ দিলেন। আমি মওলানা সাহেবকে বললাম, “আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করবে, ভয়ের কোনো কারণ নাই। আর যদি সংখ্যাগুরু না হতে পারি আইনসভায় আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হয়ে কাজ করবে। রাজনীতি স্বচ্ছ থাকবে, জগাখিচুড়ি হবে না। আদর্শহীন লোক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে।” মওলানা সাহেব একমত হলেন, আমাকে বিভিন্ন জেলায় সভার ব্যবস্থা করতে বললেন। তিনি ও আমি প্রত্যেক জেলায় ও মহকুমায় ঘুরব, কোথায় কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে ঠিক করব। শহীদ সাহেবও কয়েকদিনের মধ্যে করাচি থেকে ফিরে আসবেন এবং সমস্ত নির্বাচনের ভার নিবেন। আওয়ামী লীগের একটা জিনিসেরই অভাব ছিল, সেটা হল অর্থবল। তবে নিঃস্বার্থ এক বিরাট কর্মীবাহিনী ছিল, যাদের মূল্য টাকায় দেওয়া যায় না। টাকা বেশি দরকার হবে না, প্রার্থীরা যে যা পারে তাই খরচ করবে। জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষে।
সালাম সাহেব কিন্তু হাল ছাড়েন নাই। তিনি তখন কিছুটা কনসান্সকিপার হয়ে পড়েছিলেন হক সাহেবের। হক সাহেব রাতারাতি নিজের দল সৃষ্টি করলেন। তার নাম দিলেন, কৃষক শ্রমিক দল। দেশে কোথাও কোনো সংগঠন নাই, কয়েকজন লীগ থেকে বিতাড়িত নেতা হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব ও মোহন মিয়ার নেতৃত্বে আর কিছু পুরানা হক সাহেবের ভক্ত এসে জুটল। এরা রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে সংসার ধর্ম পালন করছিলেন। কারণ, এরা প্রায়ই পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। জনাব আবুল হাশিম সাহেবও হক সাহেবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে যোগদান না করে নিজের দল সৃষ্টি করতে। সালাম সাহেবও হক সাহেবকে আওয়ামী লীগে যোগদান করার জন্য বেশি জোর দেন নাই। কারণ, আওয়ামী লীগে সালাম সাহেবের অবস্থা ভাল ছিল না। সালাম সাহেব আমাকে একদিন বললেন, “আর কত কাল বিরোধী দল করা যায়, ক্ষমতায় না গেলে জনসাধারণের আস্থা থাকবে না। যেভাবে হয় ক্ষমতায় যেতে হবে। যুক্তফ্রন্ট করলে নিশ্চয়ই ক্ষমতায় যেতে পারব।” এই কথার উত্তরে আমি তাকে বলেছিলাম, “ক্ষমতায় যাওয়া যেতে পারে, তবে জনসাধারণের জন্য কিছু করা সম্ভব হবে না, আর এ ক্ষমতা বেশি দিন থাকবেও না। যেখানে আদর্শের মিল নাই সেখানে ঐক্যও বেশি দিন থাকে না।” তিনি একমত হতে পারেন নাই। তাকে নিয়ে বিপদ, কারণ ক্ষমতায় তার যেতেই হবে, যেভাবে হোক তাঁর ধারণা, আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে তিনি নেতা হতে পারবেন না, তার চেয়ে হক সাহেবের সঙ্গে থাকলে তার নেতৃত্ব মানতে আপত্তি হবে না। হক সাহেবকে আওয়ামী লীগে আনতে কেউ তো আপত্তি করে নাই। তবে যেসব লোক তার সঙ্গে জুটেছে তারা হক সাহেবের সর্বনাশ করবে এবং সাথে সাথে দেশের এবং আওয়ামী লীগেরও সর্বনাশ করবে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আমার ছিল না। তাই আমি বিরোধিতা করতে লাগলাম। যুক্তফ্রন্ট করবার পক্ষে জনমত সৃষ্টি কিছুটা হয়েছিল সত্য, কিন্তু সেটা ভাবাবেগের উপর। জনসাধারণ মুসলিম লীগের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের নাম জনসাধারণ জানত না।