আবুল মনসুর আহমদ সাহেব জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি সকল কিছুই ছেড়ে দিয়েছেন হাশিমউদ্দিন সাহেবের কাছে। আমি যে সেখানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অফিস করব সে বন্দোবস্ত করা হয় নাই। সমস্ত জেলায় খবর দেওয়া হয়েছে যেন সকলে উপস্থিত থাকে। আমার জানা আছে যেখানে সভা হোক না কেন শতকরা দশ ভাগ ভোটও আমার মতের বিরুদ্ধে যাবে না। অনেক জেলার কর্মীদের জন্য থাকবার বন্দোবস্ত করা হয় নাই। এই অবস্থায় আবদুর রহমান সিদ্দিকী নামে একজন কর্মীর সাহায্য পেয়েছিলাম। ছোট ছোট হোটেল ভাড়া করে বিভিন্ন জেলার সভ্যদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সভার তিন-চার দিন পূর্বে মওলানা সাহেব খবর দিলেন, তিনি সভায় উপস্থিত হতে পারবেন না। কিন্তু কেন সে কারণ কিছুই জানান নাই। আমি জানতাম, কোনো রকম বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি সরে থাকতে চেষ্টা করতেন। আমি ও খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস বাধ্য হয়ে রওয়ানা করলাম তাকে ধরে আনতে বগুড়া জেলার পাঁচবিবি গ্রাম হতে। সময়ও খুব অল্প, অনেক কাজ পড়ে আছে। বিভিন্ন জেলার কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। পার্টির যুক্তফ্রন্ট সমর্থকরা লোক পাঠিয়েছে বিভিন্ন জেলায়। খোন্দকার মোশতাক আহমদও যুক্তফ্রন্ট সমর্থক। ইলিয়াস ও আমি বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হয়ে ফুলছড়ি ঘাটে ট্রেনে উঠেছি, এমন সময় বগুড়া থেকে একটা ট্রেন আসল। আমি দেখলাম, মওলানা সাহেবের মত একজন লোক দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় বসে আছেন। ইলিয়াসকে বললাম, “দেখ তো কে?” ইলিয়াস উঁকি দিয়ে বলল, “ঐ তো মওলানা সাহেব।” আমাদের ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। তাড়াতাড়ি মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম এবং মওলানা সাহেবের কাছে পৌঁছালাম। তিনি বেশি কোনো কথা না বলে হাঁটতে লাগলেন, আমরাও তার সাথে হাঁটতে লাগলাম এবং হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম, “ব্যাপার কি? আপনি সভা ডাকতে বললেন, এখন আবার উপস্থিত হবেন না কেন?” তিনি বললেন, “তোমরা জান না, ঐকফ্রন্ট করবার জন্য তোমাদের নেতারা পাগল হয়ে গেছে। আমি কিছুতেই ঐ সমস্ত নীতিছাড়া নেতাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে চাই না। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্ট করার সংখ্যা বেশি। তোটে পারা যাবে না। আমি আর রাজনীতি করব না। আমার তো কিছুই নাই। আমি তো নির্বাচনে দাঁড়াব না। কারও ক্যানভাস করতেও পারব না, তাই আর রাজনীতি করার ইচ্ছা নাই। কাউন্সিল সভায় যোগদানও করতে পারব না।” আমি রাগ করে তাঁকে বললাম, “আপনি তো আমাদের সাথে পরামর্শ না করে ময়মনসিংহে কাউন্সিল সভা ডাকতে বলেছেন, কাউন্সিল সভা তো আরও কিছুদিন পরে ঢাকায় ডাকার কথা ছিল। তবে কাউন্সিলের মতামত আপনি জানেন না। আপনিও ইচ্ছা করলে ঐক্যফ্রন্ট করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করাতে পারবেন কি না সন্দেহ! আওয়ামী লীগের সভ্যরা বিতাড়িত মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে বহু অত্যাচার সহ্য করেছে এবং তারা জানে এরা বিরোধী দল করতে আসে নাই। আওয়ামী লীগের কাঁধে পাড়া দিয়ে ইলেকশন পাস করতে চায়, তারপর তাদের পথ বেছে নেবে। আপনি যদি উপস্থিত না হন তবে আমি টেলিগ্রাম করে সভা বন্ধ করে দিয়ে এই পথেই বাড়ি চলে যাব।”
মওলানার সঙ্গে আলাপ করতে করতে চরের ভিতর দিয়ে সর্দারের চর’ নামে একটা গ্রামে পৌঁছালাম এবং তাঁর এক মুরিদ মুসা মিয়ার বাড়িতে পৌঁছালাম। মুসা মিয়া খুবই গরিব মানুষ, মাত্র ছোট্ট ছোট্ট দুইখানা কুঁড়েঘর তার সম্বল। একটা গাছতলায় আমাদের সুটকেস ও বিছানা নিয়ে একটা মাদুরের উপর বসে পড়লাম। ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে মহাবিপদে পড়লেন। কি যে করবেন বুঝে পান না। গরিব হতে পারেন, কিন্তু এত বড় প্রাণ আমার জীবনে খুবই কম দেখেছি। ট্রেন নাই ঢাকায় ফিরে যাবার। ভাসানী সাহেবও কিছু বলছেন না। রাতে সেখানে থাকতে হবে। মুসা মিয়ার বোধহয় যা কিছু ছিল তা ব্যয় করে আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করলেন। দেড় মাইল দূরে ফুলছড়ি ঘাটে লোক পাঠিয়ে আমাদের জন্য চায়ের বন্দোবস্তও করলেন। রাতে তার এক পাশের বাড়িতে সেও মওলানা সাহেবের ভক্ত, সেখানে কাটালাম। তার বাড়িতে একটা ছোট আলাদা ঘর ছিল। মওলানা সাহেবের সাথে নরম গরম আলাপ হওয়ার পরে তিনি সভায় আসবেন বলে দিলেন। ইলিয়াসও মওলানা সাহেবের সাথে অনেক আলোচনা করল। পরের দিন সকালে আমরা দুইজন রওয়ানা করে ফিরে আসলাম। মোহাম্মদউল্লাহ সাহেব, কোরবান আলী, হামিদ চৌধুরী, মোল্লা জালালউদ্দিন পূর্বেই পৌঁছে গিয়েছে। শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করবার জন্য ঢাকায় আসতে হল। তাঁকে নিয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছালাম। আওয়ামী লীগ অফিস করবার জন্য কোন স্থান না পেয়ে হামিদ, জালাল ও মোহাম্মদউল্লাহ আজিজুর রহমান সাহেবের বাসায় একটা কামরা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছিল। আমার একলার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করেছিল হাশিমউদ্দিনের বাড়িতে। আমি কেমন করে অন্যান্য কর্মকর্তাদের রেখে শিমউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে থাকি? পূর্বে যখন গিয়েছি, আমি হাশিমউদ্দিন সাহেবের বাড়িতেই থাকতাম। খালেক নেওয়াজ, শামসুল হক, রশিদ ময়মনসিংহের বিশিষ্ট কর্মী, তারা হাশিমউদ্দিনকে পছন্দ না করলেও আমাকে ভালবাসত। তাদের সাহায্যও পেলাম কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্ত করতে। অলকা সিনেমা হলে সম্মেলন হবে। রাতে আমি খবর পেলাম, হাশিমউদ্দিন বাইরের লোক হলের মধ্যে পূর্বেই নিয়ে রাখবে অথবা আওয়ামী লীগ কাউন্সিলার নামেও কিছু বাইরের লোক নিবে যাতে তারা সংখ্যাগুরু হতে পারে।