এরপর আমি হক সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে অনুরোধ করলাম। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় তিনি যোগদানও করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, “যাঁরা চুরি করবেন তারা মুসলিম লীগে থাকুন, আর যারা ভাল কাজ করতে চান তারা আওয়ামী লীগে যোগদান করুন। আমাকে ধরে জনসভায় বললেন, “মুজিব যা বলে তা আপনারা শুনুন। আমি বেশি বক্তৃতা করতে পারব না, বুড়া মানুষ।” এ বক্তৃতা খবরের কাগজেও উঠেছিল।
এই সময় আওয়ামী লীগের মধ্যে সেই পুরাতন গ্রুপ যুক্তফ্রন্ট করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আবদুস সালাম খান, ময়মনসিংহের হাশিমউদ্দিন ও আরও কয়েকজন এজন্য প্রচার শুরু করলেন। এদিকে তথাকথিত প্রগতিশীল এক গ্রুপও বিরোধী দলের ঐক্য হওয়া উচিত বলে চিল্কার আরম্ভ করলেন। অতি প্রতিক্রিয়াশীল ও অতি প্রগতিবাদীরা এই জায়গায় একমত হয়ে গেল। কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল তখন ছিল না–একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া—যার নাম জনসাধারণ জানে। ভাসানী সাহেব ও আমি পরামর্শ করলাম, কি করা যায়। তিনি আমাকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন, যদি হক সাহেব আওয়ামী লীগে আসেন তবে তাঁকে গ্রহণ করা হবে এবং উপযুক্ত স্থান দেওয়া যেতে পারে। আর যদি অন্য দল করেন তবে কিছুতেই তার সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট করা চলবে না। যে লোকগুলি মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছে তারা এখন হক সাহেবের কাঁধে ভর করতে চেষ্টা করছে। তাদের সাথে আমরা কিছুতেই মিলতে পারি না। মুসলিম লীগের সমস্ত কুকার্যের সাথে এরা ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জড়িত ছিল। এরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতাও করেছে। মওলানা সাহেব আমাদের অনেকের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আমাকে বলে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সদস্যদের মধ্যে যেন যুক্তফ্রন্ট সমর্থকরা মাথা তুলতে না পারে।
ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হল। বেশি সংখ্যক সদস্যই যুক্তফ্রন্টের বিরোধী। কারণ, যাদের সাথে নীতির মিল নাই, তাদের সাথে মিলে সাময়িকভাবে কোনো ফল পাওয়া যেতে পারে, তবে ভবিষ্যতে ঐক্য থাকতে পারে না। তাতে দেশের উপকার হওয়ার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা এই একতা চাচ্ছিল, তাদের উদ্দেশ্য মুসলিম লীগকে পরাজিত করা এবং ক্ষমতায় যে কোনোভাবে অধিষ্ঠিত হওয়া। ক্ষমতায় না গেলে চলে কেমন করে, আর কতকাল বিরোধী দল করবে।
অতি প্রগতিবাদীদের কথা আলাদা। তারা মুখে চায় ঐক্য। কিন্তু দেশের জাতীয় নেতাদের জনগণের সামনে হেয়প্রতিপন্ন করতে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে, চেষ্টা করে সেজন্য। তাহলেই ভবিষ্যতে জনগণকে বলতে পারে যে, এ নেতাদের ও তাদের দলগুলি দ্বারা কোনো কাজ হবে না। এরা ঘোলা পানিতে মাছ ধরবার চেষ্টা করতে চায়।
মুসলিম লীগ জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই দলটার কোনো নীতির বালাই নাই। ক্ষমতায় বসে করে নাই এমন কোন জঘন্য কাজ নাই। পরিষ্কারভাবে জনগণ ও পূর্ব বাংলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই দল হতে যে লোকগুলি বিতাড়িত হয়েছিল তারা এই জঘন্য দলের সভ্যদের মধ্যেও টিকতে পারে নাই। এরা কতটুকু গণবিরোধী হতে পারে ভাবতেও কষ্ট হয়। এরা নীতির জন্য বা আদর্শের জন্য মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নাই, ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে। এই বিতাড়িত মুসলিম লীগ সভ্যরা পাকিস্তান হওয়ার পরে একদিনের জন্যও সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করে নাই। এমনকি সরকার থেকে সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করেছে। তারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে হক সাহেবের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের সাথে দরকষাকষি করতে পারে।
হক সাহেব আওয়ামী লীগে যোগদান করবেন ঠিক করে ফেলেছিলেন। এমনকি অনেকের কাছে বলেওছিলেন। এই লোকগুলি হক সাহেবের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তাঁকে বোঝাতে লাগল, আলাদা দল করে যুক্তফ্রন্ট করলে সুবিধা হবে। আওয়ামী লীগ তাঁকে উপযুক্ত স্থান দিবে না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাকে প্রধানমন্ত্রী নাও করতে পারেন, এমনই নানা কথা। তাদের নিজের দল হলে আওয়ামী লীগ বাধা দিলেও মুসলিম লীগের সাথে মিলতে পারবে নির্বাচনের পরে। মুসলিম লীগও কিছু আসন নির্বাচনে দখল করতে পারবে। প্রথমে আওয়ামী লীগের সাথে মিলে নির্বাচন করে নেওয়া যাক, তারপর দেখা যাবে। পথ খোলা থাকলে যে কোনো পন্থা অবলম্বন করা যাবে। যদিও হক সাহেবকে আমরা জানিয়ে দিয়েছিলাম, তিনি পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক আইন পরিষদে আওয়ামী লীগের নেতা হবেন, শহীদ সাহেব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভার নেতা থাকবেন।
এই সময় ভাসানী সাহেব আমাকে চিঠি দিলেন আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভা ডাকতে ময়মনসিংহে। আমার সাথে তিনি এই সম্বন্ধে আগে কোনো পরামর্শ করেন নাই। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি হাশিমউদ্দিন যুক্তফ্রন্ট চায়। আমি তাকে পছন্দ করতাম না, তা তিনি জানতেন। গোপনে গোপনে সালাম সাহেবের সাথে মিশে তিনি কিছু ষড়যন্ত্রও করতেন। আমার সমর্থক ময়মনসিংহ জেলার বিশিষ্ট কর্মী রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ও হাতেম আলী তালুকদার ও আরও অনেকে তখনও কারাগারে বন্দি।
মওলানা ভাসানীর খেলা বোঝা কষ্টকর। ময়মনসিংহ কনফারেন্সে বেশ একটা বোঝাপড়া হবে বলে আমি ধারণা করলাম। তবু আমি কনফারেন্স ডেকে বলে দিলাম, সভাপতি হিসাবে মওলানা ভাসানী আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন সভা ডাকতে। শহীদ সাহেবকে দাওয়াত করা। হল এবং তাঁকে সভায় উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হল। শহীদ সাহেব আমাকে জানিয়ে দিলেন সভার দুই দিন পূর্বে তিনি ঢাকায় পৌঁছাবেন। সমস্ত জেলায় জেলায় আমি চিঠি পাঠিয়ে দিলাম। হাশিমউদ্দিন সাহেবকে নির্দেশ দিলাম, সমস্ত কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্ত করতে এবং হোটেল ঠিক করতে যেখানে সদস্যরা নিজেদের টাকা দিয়েই খাবে। যদিও জেলা কমিটির উচিত ছিল বাইরের জেলার সদস্যদের খাবার ব্যবস্থা করা।